
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, বাংলা প্রবন্ধ রচনা, Best Unique 13 Points, PDF
সূচনা
‘বিদ্যার সাগর তুমি বিখ্যাত ভারতে।
করুণার সিন্ধু তুমি সেই জানে মনে,
দীন যে দীনের বন্ধু।’-কবি শ্রীমধুসূদন
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বাঙালি সমাজের কাছে একটি প্রাতঃস্মরণীয় নাম। বিশিষ্ট সমাজসংস্কারক, উনবিংশ শতাব্দীর প্রাণপুরুষ, বাংলা গদ্যের যথার্থ শিল্পী হলেন বিদ্যাসাগর। আধুনিক সমাজ গঠনে যিনি নিরন্তর ব্যাপৃত ছিলেন, সেই সিংহশিশু দরিদ্রের গৃহে জন্মগ্রহণ করেও বাঙালিকে শিখিয়েছেন কীভাবে আত্মবিশ্বাস, কর্ম ও নিষ্ঠার সঙ্গে বাঁচতে হয়। বঙ্গদেশে যিনি ‘দয়ার সাগর’ নামে অভিহিত হয়ে থাকেন। বিদ্যাসাগরের অনমনীয় ব্যক্তিত্ব ও অজেয় পৌরুষ আপামর মানুষের কাছে অবশ্যই শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণীয়।
জন্ম ও বংশ-পরিচয়
১৮২০ খ্রিস্টাব্দ-এ ২৬ সেপ্টেম্বর, মেদিনীপুর জেলার বীরসিংহ গ্রামে ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের (বিদ্যাসাগরের সম্পূর্ণ নাম) জন্ম। পিতা ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, মাতা ভগবতী দেবী। দরিদ্র ব্রাহ্মণ-পরিবারের সন্তান হলেও ঈশ্বরচন্দ্র ছিলেন তাঁদের সুযোগ্য সন্তান। দারিদ্র্য ঈশ্বরচন্দ্রের বলিষ্ঠ মানসিকতাকে দুর্বল করার পরিবর্তে তাঁকে করে তুলেছিল দুর্দমনীয় তেজস্বী এবং অনমনীয় জেদি।
বাল্যকাল ও বিদ্যাশিক্ষা
বালক ঈশ্বরচন্দ্র অতি শৈশবেই গ্রামের পাঠশালায় শিক্ষালাভ সমাপ্ত করে দরিদ্র পিতার হাত ধরে পদব্রজে পাড়ি দিয়েছিলেন শহর কলকাতায়। অসাধারণ মেধা ও কঠোর পরিশ্রম – এই দু’য়ের সমন্বয়ে ঈশ্বরচন্দ্র প্রতি ক্লাসে অসামান্য পারদর্শিতার সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়ে বৃত্তিলাভ করতেন। তারপর তিনি দারিদ্র্যের সকল চক্রান্তকে পরাজিত করে প্রবেশ করলেন সংস্কৃত কলেজে। অসামান্য প্রতিভাবলে বিভিন্ন শাস্ত্রে কৃতিত্ব প্রদর্শন করে তিনি হয়ে উঠলেন ‘বিদ্যাসাগর’। স্বচেষ্টায় ইংরেজি শিক্ষাও হয় অধিগত। এইভাবে কঠোর পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে তাঁর জীবনের প্রস্তুতি-পর্ব সমাপ্ত হয়।
কর্মজীবন
বিদ্যাশিক্ষা সমাপ্ত করে ১৮৪১ খ্রি. তিনি অধ্যাপকরূপে ফোর্ট উইলিয়ম কলেজে যোগদান করেন। পরে তিনি প্রথমে সংস্কৃত কলেজের সহকারী সম্পাদক এবং তারপর অধ্যক্ষের পদে নিযুক্ত হয়েছিলেন। কিন্তু কর্তৃপক্ষের সঙ্গে মতভেদ হওয়ায় তিনি সরকারি কর্ম ত্যাগ করে প্রবেশ করলেন বৃহত্তর কর্মক্ষেত্রে। মেট্রোপলিটন কলেজ তারই প্রথম ফলশ্রুতি।
দয়ার সাগর ও তাঁর মাতৃভক্তি
বাংলাদেশে বিদ্যাসাগরের প্রকৃত পরিচয় তাঁর ‘দয়ার সাগর’ নামে। তাঁর সীমাহীন দয়ার মূলে ছিল জননী ভগবতী দেবীর কাছ থেকে লব্ধ মানবতাবোধ ও পরদুঃখকাতরতা। তাঁর মাতৃভক্তি তো প্রবাদ-তুল্য। তাঁর মাতৃভক্তিই তাঁকে পরের দুঃখ-মোচনের জন্যে সকল বাধা-বিঘ্ন বিজয়ের শক্তি দান করে উত্তীর্ণ করে দিয়েছিল মহা-মানবতার এক উন্নত আকাশে।
সমাজসংস্কারক
বিধবা-বিবাহ প্রবর্তন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি। রামমোহন ভারতে সতীদাহ-প্রথা বিরোধী আন্দোলনে যেভাবে নারীজাতির মুক্তির জন্যে লড়েছিলেন, বিদ্যাসাগর সেই পথেই বিধবা বিবাহ আন্দোলন শুরু করেন। বহু-বিবাহ ও কৌলীন্য-প্রথার অনুগ্রহে ঘরে ঘরে ওঠে যে বৈধব্যের কাতর ক্রন্দন, বিদ্যাসাগর তা দূর করবার জন্যে বিধবা-বিবাহ প্রবর্তনে হলেন কৃত-সঙ্কল্প। ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে তাঁর অদম্য প্রয়াসে লর্ড ক্যানিং-এর আমলে বিধবা-বিবাহ বিধিবদ্ধ হয়। নিজের খরচে এক বিধবার বিবাহের আয়োজনও তিনি করেছিলেন। শুধু তাই নয়, নিজের ছেলের সঙ্গে এক বিধবা কন্যার বিবাহও দিয়েছিলেন তিনি। তাছাড়া বাল্য-বিবাহ নিবারণও তাঁর অন্যতম কীর্তি।
শিক্ষা-বিস্তার
সমাজের যত দুঃখ, যত ব্যভিচার – শিক্ষার অভাবই তার মূল উৎস। এই কুসংস্কারাচ্ছন্ন জড়তাগ্রস্ত সমাজের জাগরণের জন্যে চাই প্রগতিধর্মী পাশ্চাত্য শিক্ষা। তাই দেশময় শিক্ষার জালবিস্তারই ছিল তাঁর সমাজ-সংস্কারের প্রাথমিক সোপান। নারীশিক্ষা বিস্তারের জন্যেও ছিল তাঁর সমান উৎসাহ। শিক্ষাক্ষেত্রে এই প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গি সেকালের এক ব্রাহ্মণ-সন্তানের পক্ষে সত্যিই বিস্ময়কর।
সংস্কৃত কলেজের পুনর্গঠনের রিপোর্টে শিক্ষানীতি সম্পর্কিত তাঁর প্রথম চিন্তাধারার পরিচয় পাওয়া যায়। নিজের গড়ে তোলা মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশনকে বেসরকারি কলেজে প্রতিষ্ঠিত করেন। বাংলায় শতাধিক বিদ্যালয় স্থাপনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। তাছাড়া মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদানের জন্য তিনি সর্বদা সচেষ্ট ছিলেন।
সাহিত্য-কর্মের প্রসার ও ব্যাপ্তি
বাংলা-সাহিত্য বিদ্যাসাগরের প্রতিভার কাছে গভীরভাবে ঋণী। ‘বেতাল-পঞ্চবিংশতি ‘বর্ণপরিচয়’, ‘সীতার বনবাস’, ‘শকুন্তলা’ প্রভৃতি গ্রন্থ শিল্প-সৌকর্যময় বাংলা গদ্যের প্রথম নিদর্শন। তাঁর ‘বর্ণ পরিচয়ের’ ‘জল পড়ে, পাতা নড়ে’ তো রবীন্দ্রনাথের শৈশবের মেঘদূত। এখানে বিদ্যাসাগর রচিত ও অনূদিত কয়েকটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের নামোল্লেখ করা হল–
শিক্ষামূলক গ্রন্থ
- বর্ণপরিচয়
- সংস্কৃত ব্যাকরণের উপক্রমণিকা
- ব্যাকরণ কৌমুদী
অনুবাদ গ্রন্থ
- বেতাল পঞ্চবিংশতি
- শকুন্তলা
- সীতার বনবাস
- বাঙ্গালার ইতিহাস
- বোধোদয়
- কথামালা
- ভ্রান্তিবিলাস
মৌলিক গ্রন্থ
- সংস্কৃত ভাষা ও সংস্কৃত সাহিত্য বিষয়ক প্রস্তাব
- বিধবা বিবাহ চলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব
- প্রভাবতী সম্ভাষণ
- জীবন-চরিত
রচনারীতি
বিদ্যাসাগরের রচনারীতি সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন – “বিদ্যাসাগর গদ্যভাষার উচ্ছৃঙ্খল জনতাকে সুবিভক্ত, সুবিন্যস্ত, সুপরিচ্ছন্ন ও সুসংহত করিয়া তাহাকে সহজ গতি এবং কার্যকুশলতা দান করিয়াছেন।” তাঁর গদ্য বর্ণনায় ভাষার মাধুর্য, শব্দঝংকার মনের মধ্যে যেন স্বপ্নরাজ্যের সৃষ্টি করে। বিদ্যাসাগরের “সীতার বনবাস”, “শকুন্তলা” অনুবাদ গ্রন্থগুলি বাংলা গদ্যসাহিত্যের সম্পদ বলা চলে। এককথায় বাংলা গদ্যরচনায় বিদ্যাসাগরের নাম স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
চরিত্র-সুষমা
বিদ্যাসাগর মহাশয়ের মতো সু-দৃঢ় পুরুষকার চরিত্র, এমন বলিষ্ঠ সংগ্রামী চেতনা এদেশে প্রকৃতই দুর্লভ। অথচ বিদ্যাসাগর মহাশয়ের জীবন-চরিতের প্রতি পাতাতেই দেখা যায় যে, “বিদ্যাসাগর কাঁদিতেছেন।” অর্থাৎ, তাঁর মধ্যে কঠোরতা ও কোমলতায় ঘটেছিল এক অপূর্ব যুগল-সম্মিলন। তাঁর মাতৃভক্তির অনেক গল্প প্রচলিত, যেখানে তাঁর সরলতা আমাদের বিস্মিত করে। পাশাপাশি তিনি যখন একজন সমাজসংস্কারক কিংবা সরকারি আধিকারিকের ভূমিকায় অবতীর্ণ, তখন তাঁর বলিষ্ঠ আত্মপ্রত্যয়ী চরিত্র আমাদের মুগ্ধ করে। আবার যখন মধুকবি বিদেশে অর্থকষ্টে জীবনযাপন করছেন, তখন তিনি ‘দয়ার সাগর’ হয়ে অর্থ সাহায্য করতে কুন্ঠিত হচ্ছেন না। এককথায় তাঁর মধ্যে বাঙালি ও ইংরেজ চরিত্রবৈশিষ্ট্যের যুগলসম্মিলন লক্ষ করা যায়।
জাতীয়তাবোধ
বর্তমান মেরুদণ্ডহীন বাঙালি জাতির কাছে বিদ্যাসাগর ছিলেন আত্মমর্যাদাসম্পন্ন স্বদেশপ্রেমিক। জাতির ও দেশের কল্যাণে তিনি নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন। সিপাহী বিদ্রোহ দমন করার জন্য ইংরেজরা সংস্কৃত কলেজে অস্থায়ী আস্তানা স্থাপন করতে চাইলে বিদ্যাসাগর তার প্রতিবাদ করেন। জাতীয় কংগ্রেসকে তিনি সশস্ত্র আন্দোলনে রূপায়িত হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন। মা ও দেশের মাটির প্রতি তাঁর টান ছিল সহজাত।
মানবিকতা বোধ
তিনি শুধু বিদ্যার সাগরই ছিলেন না, তিনি ছিলেন দয়ার সাগর, করুণার সাগর। শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁকে ‘দয়ার সাগর’ই বলতেন। পরদুঃখকাতরতা তাঁকে দীন-দুঃখীর চোখের জল মোছাতে সচেষ্ট করেছিল। মায়ের কথাতেই তিনি গ্রামের মানুষের জন্য অন্নসত্র খুলেছিলেন, শীতার্ত মানুষকে গরম বস্ত্র দান করতেন। বহু দাতব্য চিকিৎসালয়ও তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। প্রবাসী কবি মধুসূদনকে চরম আর্থিক অনটনের হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন তিনি। দেশাচার ও লোকাচারের ঊর্ধ্বে মানবিকতাকে তিনি মূল্য দিয়েছিলেন বেশি। এ পৃথিবীকে তিনি সাধারণ অবহেলিত মানষদের বসবাসযোগ্য করে যাওয়ার মন্ত্রে ব্রতী হয়েছিলেন।
উপসংহার
১৮৯১ খ্রিস্টাব্দের ২৯শে জুলাই এই অজেয় পৌরুষ-শিখা চির-নির্বাপিত হয়। তাঁর মহান চরিত্রের মধ্যে প্রাচীন ভারতীয় ঋষির অতলান্ত প্রজ্ঞা, ইংরেজ জাতির দুর্বার তেজস্বিতা এবং বাঙালি জননীর স্নেহ-সুকোমল হৃদয়ের সম্মিলন ঘটেছিল। তাঁর চিন্তা ও চেতনা, যুক্তি-বুদ্ধি, ব্যক্তিত্ব ও পৌরুষ, শিক্ষাদীক্ষা, দয়াবোধ এবং সর্বোপরি মানবিকতা – এসবের একত্র সমাহার বর্তমান দিনেও দুর্লভ। আদর্শ জীবন ও চরিত্রের যে বিশাল বনস্পতি তিনি বাংলার মাটিতে রেখে গিয়েছেন, তার ছায়া আজ সমগ্র জাতির বিশ্রাম-স্থল ।
“ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর” সংক্রান্ত প্রবন্ধ রচনাটি কেমন হল কমেন্টে জানাতে ভুলো না। নিজেরা নিজেদের মত করে এই বিষয়ে আরো তথ্য সংযোজন-বিয়োজন করে নিতে পার।
জীবনী-মনীষী সংক্রান্ত আরও প্রবন্ধ রচনা দেখ এখানে