Last Update : November 21, 2023
কমনওয়েলথ গেমস ২০২২ প্রবন্ধ রচনা PDF
ভারত ও কমনওয়েলথ গেমস ২০২২
“স্বর্গের খেলা মর্ত্যের ম্লান ধূলায় হেলায়,
দুঃখেরে লয়ে আনন্দ খেলে দোলন-খেলায়”
–রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ভূমিকা
আধুনিক কর্মব্যস্ততার যুগে মানুষের সঙ্গে মানুষের মিলনের সবচেয়ে বড় মাধ্যম হল খেলাধুলো। – তাই আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে মাঝে মাঝে আয়োজিত হয় বিভিন্ন খেলাধুলো। এবারের বার্মিংহাম কমলওয়েলথ গেমস্ ২০২২ তার একটি উদাহরণ। সদ্যসমাপ্ত এই খেলার আসরে যা ঘটলো তারই সার্বিক মূল্যায়ন এই রচনার উদ্দেশ্য।
অনুষ্ঠানের সূচনা
এবারের ২২তম কমনওয়েলথ্ গেমস্ ২৮ জুলাই ২০২২ থেকে ৮ আগস্ট ২০২২ পর্যন্ত হল এবং আয়োজক দেশ হিসেবে ইংল্যান্ড এই নিয়ে তৃতীয়বার এই খেলার আয়োজন করল। ২৮ জুলাই ইংল্যান্ডের আলেকজান্ডার স্টেডিয়ামে বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে সূচনা হয় এবারের বহু আকাঙ্ক্ষিত কমনওয়েলথ গেমস্। এবারের Motto ছিল ‘Sport is just the beginning’.
অংশগ্রহণকারী দেশ
৭২টি দেশ এই কমনওয়েলথ্ গেমসে অংশগ্রহণ করে। ভারতসহ অস্ট্রেলিয়া, বাংলাদেশ, কানাডা, সাইপ্রাস, ইংল্যান্ড, ঘানা, মালয়েশিয়া, নিউজিল্যান্ড, পাকিস্তান, সিঙ্গাপুর, শ্রীলঙ্কা প্রভৃতি দেশ এই খেলায় অংশগ্রহণ করে। প্রায় ৫০০০ এ্যাথলিট এবারের কমনওয়েলথ্ গেমসে অংশগ্রহণ করে। ভারত থেকে এবারের গেমস্-এ ২১০ জন ক্রীড়াবিদ অংশ নিয়েছিলেন। এবং পার্শ্ববর্তী দেশ বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৩০ জন ক্রীড়াবিদ এবারের গেমস্-এ অংশ নেন।
খেলাধুলোর বিবরণ
ক্রীড়াবিশ্বে কৌলিন্যের বিচারে কমনওয়েলথ গেমসের স্থান অলিম্পিক্স এবং এশিয়ান গেমসের পর। আমেরিকা, চিন, রাশিয়া, জাপান, ফ্রান্স, জার্মানির মতো ক্রীড়াবিশ্বের প্রথম সারির দেশগুলি কমনওয়েলথ গেমসে অংশ নেয় না। বিশ্বের প্রথম সারির অনেক ক্রীড়াবিদও অংশগ্রহণ করেন না তুলনায় কম গুরুত্বপূর্ণ কমনওয়েলথ গেমসে। তবু চার বছর অন্তর কমনওয়েলথ গোষ্ঠীর দেশগুলিকে নিয়ে আয়োজিত এই ক্রীড়াযজ্ঞের গুরুত্ব রয়েছে। অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, কানাডার মতো শক্তিধর কিছু দেশ এই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে।
কমনওয়েলথ্ গভর্নিং বডিগুলি থেকে অনুমোদিত হয় যে, ২০টি খেলা থেকে কমপক্ষে ১৫টি খেলা থাকবে কেন্দ্রীয় অংশে। প্রধান খেলা ছিল- এ্যাথলেটিকস্, ব্যাডমিন্টন, বক্সিং, হকি, লন বল, নেট বল ফর উইমেন, রাগবি, স্কোয়াস, সুইমিং এবং ওয়েটলিফটিং। এছাড়া নতুন যুক্ত হওয়া প্রধান খেলাগুলি হলো টেবিল টেনিস, রোড সাইক্লিং, রেস্লিং ইত্যাদি। সংহত প্রতিবন্ধী প্রতিযোগিতা ছিল সাঁতার, এ্যাথলেটিক্স, সাইক্লিং, টেবিল টেনিস, পাওয়ার লিফটিং এবং লন বল খেলাগুলিতে। এই খেলায় ২৮০টি ইভেন্টের প্রতিযোগিতা হয়। সর্বোপরি ২০টি খেলায় ২৮০টি ইভেন্টে এবারে প্রতিযোগিতা হয়।
রেকর্ড সমূহ
যে দশটি দেশ এই খেলায় উপরের দিকে আছে তাদের নাম হল–অস্ট্রেলিয়া, (মোট ১৭৮টি মেডেল), ইংল্যান্ড (মোট ১৭৬টি মেডেল), কানাডা (মোট ৯২টি মেডেল), ভারত (মোট ৬১টি (মডেল), নিউজিল্যান্ড (মোট ৪৯টি মেডেল), স্কটল্যান্ড (মোট ৫১টি মেডেল), নাইজেরিয়া (মোট ৩৫টি মেডেল), ওয়েলস (মোট ২৮টি মেডেল), সাউথ আফ্রিকা (মোট ২৭টি মেডেল), মালয়েশিয়া (মোট ২৩টি মেডেল)। বলাবাহুল্য আয়োজক দেশ মেডেল সংখ্যার নিরিখে দ্বিতীয় স্থানে আছে। তবে এই তালিকা স্বর্ণপদক লাভের সংখ্যা অনুযায়ী উপর থেকে নীচের দিকে সাজানো হয়েছে।
বার্মিংহামে পদক সংখ্যার বিচারে অস্ট্রেলিয়া এবং ইংল্যান্ড বাকি সব দেশের ধরাছোঁয়ার বাইরে। ৬৭টি সোনা, ৫৭টি রুপো এবং ৫৪টি ব্রোঞ্জ–সহ মোট ১৭৮টি পদক জিতে তালিকার শীর্ষে অস্ট্রেলিয়া। ৫৭টি সোনা, ৬৬টি রুপো, ৫৩টি ব্রোঞ্জ-সহ মোট ১৭৬টি পদক নিয়ে দ্বিতীয় স্থানে ইংল্যান্ড। তালিকায় তৃতীয় স্থানে শেষ করা কানাডার সংগ্রহ ২৬টি সোনা, ৩২টি রুপো, ৩৪টি ব্রোঞ্জ-সহ মোট ৯২টি পদক। ভারতের স্থান পদক তালিকায় চতুর্থ। ২২টি সোনা, ১৬টি রুপো এবং ২৩ ব্রোঞ্জ-সহ মোট ৬১টি পদক জিতেছেন ভারতীয় ক্রীড়াবিদরা। তালিকার পঞ্চম স্থানে শেষ করা নিউজিল্যান্ডের সংগ্রহ ২০টি সোনা, ১২টি রুপো এবং ১৭টি ব্রোঞ্জ-সহ মোট ৪৯টি পদক।
ভারত ও কমনওয়েলথ ২০২২
বার্মিংহাম কমনওয়েলথ গেমস্-এ পদক তালিকায় ভারত চতুর্থ স্থানে শেষ করেছে। মোট পদকের সংখ্যাতেও ভারতের স্থান চতুর্থ। ২০১৮ সালে গোল্ড কোস্ট-এ ভারত তৃতীয় স্থান লাভ করেছিল। এ বারের ৬১টি পদকের মধ্যে লন বোল থেকে একটি করে সোনা ও রুপো, জুডোয় দু’টি রুপো ও একটি ব্রোঞ্জ, হকিতে একটি করে রুপো ও ব্রোঞ্জ পদক রয়েছে। রুপো এসেছে প্রথম বার হওয়া মহিলাদের ক্রিকেট থেকে। আগের গেমসে এই খেলাগুলিতে কোনও পদক ছিল না ভারতের। লন বোলে যে ভারত অংশ নেয়, সেটাই অনেকে জানতেন না। মহিলাদের দল সোনা জেতার পর নিয়মকানুন জানতে শুরু করেছেন অনেকেই। রাতারাতি এই খেলার সমর্থকের সংখ্যাও বেড়ে গিয়েছে।
এ ছাড়া, অ্যাথলেটিক্সে ৫টি পদক বেড়েছে। এই বিভাগটি বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এর আগে অ্যাথলেটিক্সের কোনও বিভাগেই ভারত ভাল ফল করতে পারত না। এ বার ট্রিপল জাম্পের মতো ইভেন্টে সোনা, রুপো দুটোই জিতেছে ভারত। লং জাম্পে পদক জিতেছেন মুরলী শ্রীশঙ্কর। রেস ওয়াকে দু’টি পদক এসেছে।
ভারোত্তলনে মীরাবাই চানু, অচিন্ত্য শিউলি; কুস্তিতে সাক্ষী মালিক, বজরং পুনিয়া; ব্যাডমিন্টনে পিভি সিন্ধু; প্যারা পাওয়ার লিফটিং-এ সুধীর; প্যারা টেবিল টেনিসে ভাবিনা পটেল সোনার পদক পেয়ে ভারতকে গর্বিত করেছেন। মোট ২২টি সোনার পদক ভারতীয়রা লাভ করেছেন।
প্রতি বছরই খেলার বিভিন্ন ইভেন্টে পারফরম্যান্সের উন্নতি হচ্ছে। তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন রেকর্ড। সেই নিরিখে বার্মিংহাম কমনওয়েলথ গেমসে ভারতীয়দের পারফরম্যান্সকে গোল্ড কোস্টের থেকে ভালই বলা যেতে পারে। শ্যুটিং বাদ দিয়ে অন্য খেলাগুলি থেকে আগের বারের তুলনায় ১১টি পদক বেশি এসেছে। পদক এসেছে চারটি নতুন খেলায়। কৃতিত্ব অবশ্যই ক্রীড়াবিদদের। তাঁদের প্রস্তুতি, পরিশ্রম, পদক জয়ের জেদই ক্রীড়াবিশ্বে ভারতকে কিছুটা হলেও এগিয়ে দিল।
সমাপ্তি অনুষ্ঠান
৮ আগস্ট ২০২২ এ আলেকজান্ডার স্টেডিয়ামে এই গেমের সমাপ্তি টানা হয়। বহু খ্যাতনামা শিল্পী ও ব্যান্ড অনুষ্ঠানটিকে বর্ণাঢ্য করে তোলেন। আনুষ্ঠানিকভাবে গেমসের সমাপ্তি ঘোষণার পাশাপাশি ২০২৬-এর ২৩ তম কমনওয়েলথ গেমস-এর আয়োজক দেশ অস্ট্রেলিয়াকে পতাকা সমর্পণ করা হয়।
উপসংহার
কমনওয়েলথ গেমসের সাফল্য ও ব্যর্থতা অবশ্যই আছে। এটা মাথায় রেখে বলা দরকার, অ্যাথলেটিক্সে জামাইকা এবং আফ্রিকার মতো দেশগুলি অংশগ্রহণ করলেও, তাঁরা দেশের সেরা ক্রীড়াবিদদের এই প্রতিযোগিতায় পাঠায় না। এখানে বরং দেখে নেওয়া হয় নতুন প্রতিযোগীদের, যাঁরা আগামী দিনে তারকা হয়ে উঠতে পারেন। আসল ক্রীড়াবিদদের রেখে দেওয়া হয় অলিম্পিক্স, বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপের জন্যে, যেগুলি গুরুত্বের বিচারে অনেক এগিয়ে। ভারত থেকে সেখানে প্রথম সারির ক্রীড়াবিদরাই এই প্রতিযোগিতায় অংশ নেন। ফলে আরও বেশি কঠিন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে গেলে নিজেদের মান অনেক বাড়াতে হবে। যাই হোক, এই বিরাট ক্রীড়াযজ্ঞে অংশগ্রহণকারী দেশ হিসাবে ভারতের হয়ে আমরা এজন্যই গর্ববোধ করব যে, বিশ্বের দরবারে ভারত খেলাধুলোর ক্ষেত্রে মোটেই পিছিয়ে নেই।