Last Update : December 10, 2023
বিতর্কমূলক রচনায় নির্বাচিত বিষয়ের উপর পক্ষে বা বিপক্ষে একটি মত পরীক্ষায় দেওয়া হয়। ছাত্রছাত্রীদের দেয় বিষয়ের উপর পক্ষে/বিপক্ষে লিখতে হয় সংহতভাবে। বিষয়টি বুঝে নিয়ে, নানা যুক্তিক্রম সাজিয়ে প্রতিপক্ষের যুক্তি খণ্ডন করে নিজের মত প্রতিষ্ঠা করাই এই ধরণের রচনার মূল বৈশিষ্ট্য।
জীবিকার আদর্শ স্থান বিদেশ, উচ্চমাধ্যমিক বিতর্ক রচনা, PDF
(১) ‘বিদেশ’ শব্দটার মধ্যেই একটা আকর্ষণ লুকিয়ে আছে। বিশেষ করে আমরা ভারতীয়রা, তৃতীয় বিশ্বের অধিবাসীরা বিলেত বলতেই বুঝে নিই আমেরিকা, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, স্পেন, অস্ট্রেলিয়া প্রভৃতি দেশগুলো। আমাদের মনে দীর্ঘদিনের ধারণা আছে যে, বিদেশে সর্বমুখ সুলভে পাওয়া যায়।
(২) ‘ছাত্রানাং অধ্যয়নৎ তপ’। অধ্যয়নের মাধ্যমে আত্মজ্ঞান অর্জনের পাশাপাশি আত্মপ্রতিষ্ঠাও তাদের লক্ষ্য। সকলেই চায় উন্নত জীবনযাপন। এ কথাও সত্য। কেন-না আত্মোন্নতি প্রতিটি জীবেরই ধর্ম। কিন্তু জীবিকার আদর্শ জায়গা বিদেশ এ কথা মেনে নেওয়া আসলে স্বদেশভূমিকেই অবমাননা করা।
(৩) জননী জন্মভূমি স্বর্গাদপী গরীয়সী। এ কথা বাস্তব যে, ধনস্ফীতিতে এবং প্রাচুর্যে তথাকথিত বিদেশ উন্নত। কিন্তু মায়ের দেওয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলে নেওয়ার যে সুখ তাকে কী অস্বীকার করা যায়? তবু অনেকেই তা করার বাসনা রাখেন এবং আত্মসুখ ও স্বার্থকেই তারা মোক্ষ মনে করেন। ফলে বিদেশের নামে অর্থসমৃদ্ধ জীবনকেই তারা বেছে নেন। তাই তাদের বিদেশ কখনও মধ্যপ্রাচ্য, কখনও জাপান-সিঙ্গাপুর, কখনও ইংল্যান্ড-আমেরিকা-অস্ট্রেলিয়া-কানাডা-ফ্রান্স ইত্যাদি। লক্ষ করলে দেখা যায় বিদেশের সংজ্ঞায় কখনও আফ্রিকার দেশ বা প্রতিবেশী বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা ইত্যাদির কথা আসে না।
(৪) মানবজীবন কেবল উপভোগের জন্য নয়। আত্মপ্রতিষ্ঠা ও সমষ্টি স্বার্থও সেখানে মুখ্য। কিন্তু বিচ্ছিন্ন মানুষজন সুখের মিথ্যে স্বপ্নে বিভোর হন। ফলস্বরূপ অর্থ উপার্জনে তারা বিসর্জন দেন সম্মান, ভুলে যান দেশের মর্যাদা। কোনো কাজই ছোটো নয় জানি। কিন্তু কেবল অর্থের জন্য মধ্যপ্রাচ্যে ভারবাহক, মোটবাহক হওয়া কিংবা অস্ট্রেলিয়ার পেট্রল পাম্পে, লোকের বাড়ির আবর্জনা পরিষ্কারের কাজের জন্য ‘বিলিতি জীবনযাপন’ কতখানি সংগত তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে।
(৫) বিদেশ সম্পর্কে আরও এক আকর্ষণ সেখানকার বর্ণময়, জাঁকজমকপূর্ণ জীবনযাত্রা। কিন্তু সে জীবনযাত্রার সঙ্গে আমাদের জীবনাদর্শের মিল কোথায়? এজন্য এককালে কবি ব্যঙ্গ করে বলেছিলেন— ‘আমরা বিলেত ফেরতা ক’ভাই / আমরা সাহেব সেজেছি সবাই।’ পরানুকরণ ও পরধন ভোগের লোভী মানসিকতাই এখানে প্রমাণিত হয় এ আচরণে। আমাদের দেশের গণ্ডি ক্ষুদ্র নয়। সে তার অন্তহীন পরিসীমায় ব্যাপ্ত। তাই তো বারবার সে বিশ্বকে জ্ঞানে-ধর্মে বিজ্ঞানে-দর্শনে-কর্মে-সাধনায় শিল্পে-সাহিত্যে সমৃদ্ধ করেছে। অনাদিকালের অতীত থেকে ভেসে আসে তার শাশ্বত কল্যাণ মন্ত্র। যে নিজের দেশকে চেনে না, জানে না তার মর্ম সেই কেবল বলতে পারে দেশের গণ্ডি ক্ষুদ্র, সেই দিতে চায় বিদেশকে অগ্রাধিকার। প্রকৃত অর্থে এটি এক রুগ্ণ, পরানুকরণকারী, নিজস্বতাবিহীন এক মানসিকতা। কেবল এমন ভোগী মানুষরাই মনে করতে পারে বিদেশে রয়েছে জীবন উপভোগের অফুরন্ত সুযোগ।
(৬) ছাত্রজীবন গড়ে ওঠে শিক্ষার প্রকৃত সত্য অনুধাবনে। অভিভাবকদের লালনও সেখানে অত্যাবশ্যক ও অনিবার্য। কিন্তু আমার জীবন তো আমার, আমি তো আমার মতোই হতে চাইব। অন্যের চাহিদা পুরণে নিজের জীবনকে পরিচালনা করা সুস্থতা নয়। কেবল অভিভাবক, বন্ধুজন, আত্মীয় খুশি হবে, নাম করবে এর জন্যই কি মানুষ জীবিকা গ্রহণ করে? জীবিকা মানুষের আত্মপ্রতিষ্ঠা। জীবনের বেঁচে থাকার উপকরণ। কিন্তু জীবনের প্রকৃত কল্যাণ সত্য-সুন্দর-আত্মবিকাশের মধ্যে লুকিয়ে থাকে। পরের মনতুষ্টি করায় নয়। বিদেশি শিক্ষা প্রয়োজনীয় হতে পারে কিন্তু তার জন্য বিদেশে প্রতিষ্ঠা লাভ করার কোনো বাসনা নেই। নিজেদের দেশের মেধা, শ্রম, স্বপ্ন, তারুণ্য নিজের দেশের কল্যাণেই ব্যবহৃত হোক তবেই আগামীকালে ভারত আবার জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসন লাভ করবে।