Last Update : December 1, 2023
বাংলা কাব্য ও নাট্য সাহিত্যে মাইকেল মধুসূদন দত্ত এক পরিচিত নাম। ২০২৪ সাল তাঁর জন্মের দ্বিশতবর্ষ। দীর্ঘ দুশো বছরের পথ পরিক্রমায় তাঁর রচনা আজও অমলিন। এই প্রবন্ধ রচনায় তাঁর জীবন ও সাহিত্যকর্মের ছাত্রপাঠ্য রূপ প্রকাশিত হল।
দ্বিশতবর্ষে মাইকেল মধুসূদন দত্ত, বাংলা প্রবন্ধ রচনা, Best Unique 10 Points, PDF
ভূমিকা
মধুসূদনের ব্যক্তিগত জীবন ও সাহিত্যজীবন অভিন্ন। জীবনে যেমন সংস্কারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছেন, কাব্য কিংবা নাট্যসাহিত্যেও তেমনি পুরাতন ধ্যান-ধারণা বিচুর্ণিত করে নতুন ভাবধারা ও আঙ্গিক শৈলী প্রতিষ্ঠা করেন। যৌবনে উচ্চাশায় তাড়িত হয়ে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ, বিদেশিনী বিবাহ, গৃহত্যাগ, বান্ধবহীন নিঃসঙ্গ জীবনযাপন ব্যক্তিগত জীবনে বিদ্রোহের পরিচায়ক। তেমনি সাহিত্যের ক্ষেত্রে নানা বাধা উপেক্ষা করে নবজীবনাদর্শের প্রচার তাঁর বিদ্রোহী মানসিক বার্তার পরিচয় বহন করে।
প্রারম্ভিক জীবন
মধুসূদনের জন্ম ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দের ২৫ জানুয়ারি যশোর জেলার (বর্তমানে বাংলাদেশে) সাগরদাঁড়ি গ্রামে। সাগরদাঁড়ির সম্ভ্রান্ত দত্তবংশে জন্ম হয়েছিল তাঁর। পিতা রাজনারায়ণ দত্ত ছিলেন কলকাতার সদর দেওয়ানি আদালতের এক খ্যাতনামা উকিল। মাতা জাহ্নবী ছিলেন একজন জমিদার কন্যা। গ্রাম্যজীবনে বেড়ে উঠলেও মধুসূদনের প্রকৃত মানসচরিত্র গঠনে এই সময় উপেক্ষনীয় ছিল না।
শিক্ষাজীবন
প্রথম পর্বে মধুসূদনের বাল্য শিক্ষা শুরু হয় মাতা জাহ্নবী দেবীর কাছে। মায়ের কাছেই ভারতীয় মহাকাব্য, পুরাণ কাহিনির সম্বন্ধে অবগত হয়ে এগুলির প্রতি আকৃষ্ট হন। গ্রামের টোলে সংস্কৃতের পাশাপাশি ফারসিও শিখেছিলেন তিনি। তবে তিনি ছিলেন বহুভাষাবিদ।
গ্রাম্য পরিবেশ থেকে তিনি যখন কলকাতায় এলেন তখন তাঁর শিক্ষাজীবনের দ্বিতীয় পর্বের সূচনা হল। হিন্দু কলেজে উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য ভর্তি হন। এইসময় থেকেই তাঁর সাহিত্যিক প্রতিভার বিচ্ছুরণ লক্ষ করা গিয়েছিল। এই কলেজের শিক্ষকদের আদর্শ উদ্বুদ্ধ করেছিল মধুসূদনকে। কিন্তু খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণের পর অর্থাভাবে হিন্দু কলেজ ত্যাগ করতে হয়। যদিও এরপর নিয়মিত আর পড়াশুনো চালিয়ে যেতে পারেননি। পরবর্তীকালে তিনি ওকালতি পড়তে বিলেতযাত্রা করেছিলেন।
কর্মজীবন
খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করায় পিতা তাঁকে ত্যজ্যপুত্র করলে পড়াশুনো ছেড়ে চাকরির সন্ধানে নিয়োজিত করেন। যদিও অনন্যোপায় হয়ে মাদ্রাজ গিয়ে কিছুদিন একটি স্কুলে পড়িয়েছিলেন। তবে অর্থাভাব থেকে মুক্তি পেতে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লিখতে শুরু করেন। পরবর্তীকালে বিলেত থেকে আইনের ডিগ্রি লাভ করলেও কলকাতায় ফিরে ওকালতি করেননি। এককথায় অর্থাভাব ছিল তাঁর জীবনে একান্ত সঙ্গী।
সাহিত্যচর্চা
তিনি ছিলেন মানবতাবাদ ও বিশ্বসাহিত্যের সাধক হয়ে ওঠেন। তিনি অক্লান্ত নিষ্ঠা নিয়ে ইংরেজী, হিব্রু, ল্যাটিন, গ্রীক প্রভৃতি ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যয়ন করেছেন। এবং অনতিকাল পরেই অধ্যয়ন সাধনার সিদ্ধিতে মাতৃভাষাকে সমৃদ্ধ করতে থাকেন। বাঙালি কবিদের মধ্যে মধুসূদনের চেতনার সর্বপ্রথম প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সমন্বয় সাধিত হয়েছিল।
মধুসূদন বাংলা মহাকাব্য, সনেট, নাটক, প্রহসন প্রভৃতির পথিকৃৎ শিল্পী। তাঁর বাংলা রচনাবলী নিম্নরূপ :
(১) নাটক – রত্নাবলী, শর্মিষ্ঠা, পদ্মাবতী ও কৃষ্ণকুমারী,
(২) কাব্য – তিলোত্তমাসম্ভব, মেঘনাদবধ, বীরাঙ্গনা কাব্য, বীরাঙ্গনা কাব্য, চতুর্দশপদী কবিতাবলী, হেক্টরবধ ও মায়াকানন (মৃত্যুর পর প্রকাশিত)।
(৩) প্রহসন – ‘বুড়োশালিকের ঘাড়ে রোঁ’, একেই কি বলে সভ্যতা?
বাংলা সাহিত্যের সর্বক্ষেত্রে তিনি পথ-প্রদর্শক। তাঁর আগে বাঙালি কবি ও নাট্যকাররা ইংরেজি সাহিত্যের অক্ষম অনুকরণে নিয়োজিত ছিলেন। ‘তিলোত্তমাসম্ভব’ কাব্যে তিনি মহাকাব্যের যে আভাস দিয়েছিলেন, ‘মেঘনাদবধ’ কাব্যে তারই সার্থক পরিণতি দেখা দিল। ‘মেঘনাদবধ’ কাব্য বাংলা সাহিত্যের একমাত্র মহাকাব্য। ‘ব্রজাঙ্গনা’ গীতিরসপূর্ণ জাতীয় কাব্য। ‘বীরাঙ্গনা’ পত্রকাব্য যা নারী-বীরদের দুঃসাহসী কাব্য। ‘চতুর্দশপদী কবিতাবলীতে তিনি বাংলায় সনেট রচনার পথ প্রদর্শন করেন।
বাংলা সাহিত্যে নবজাগরণের অগ্রদূত
বাংলা সাহিত্যে আধুনিকতার ভগীরথ মাইকেল মধুসূদন দত্তের ছিলেন অনন্যসাধারণ এক কাব্য প্রতিভার অধিকারী। ছাত্রজীবনেই পাশ্চাত্য সাহিত্যের প্রতি প্রগাঢ় অনুরাগ থেকে নদ আদর্শে দীক্ষিত হলেন। মধ্যযুগীয় দেবনির্ভরতা পরিত্যাগ করে আধুনিক মনন ও চেতনার আদর্শকে গুরুত্ব দিয়ে রচনা করলেন মানবতার জয়গান। সেখানে সুখ-দুঃখ, বিরহ-মিলন স্থান পেল। নারীকে দিলেন তাদের যোগ্য সম্মান, বীরত্বের আদর্শে বিনির্মাণ করলেন পৌরাণিক কাহিনিগুলিকে।
স্বদেশচেতনা ও জাতীয়তাবোধ
প্রথম জীবনে ইংরাজি সাহিত্যচর্চায় মনোনিবেশ করলেও বাংলা ভাষার অন্তর্নিহিত সৌন্দর্য অচিরেই তাঁকে মুগ্ধ করে। এ প্রসঙ্গে একটি সনেটে তিনি স্মৃতিচারণ করেছেন,
হে বঙ্গ ভাণ্ডারে তব বিবিধ রতন; তা সবে (অবোধ আমি) অবহেলা করি, পর-ধন-লোভে মত্ত, করুনি ভ্রমণ পরদেশে... "বঙ্গভাষা" কবিতা
এভাবেই তিনি স্বদেশকে ভালোবেসেছেন। স্বদেশ ও স্বাজাতির প্রতি তাঁর অকৃত্রিম ভালোবাসার খোঁজ পেয়েছিলেন বিদ্যাসাগর থেকে বঙ্কিমচন্দ্র। ‘মেঘনাদ বধ’ কাব্যে যে বীরত্ব, মহত্ত্ব, স্বদেশের প্রতি ভালোবাসার কথা এসেছে তা আসলে কবির অন্তরানুভূতিরই প্রতিচ্ছবি।
মধুসূদনের বিদ্রোহী কবিসত্তা
মধ্যযুগীয় সংস্কারের আচ্ছন্ন একটা সমাজে দাঁড়িয়ে মধুসূদন ইউরোপীয় রেনেসাঁসের আলোয় আলোকিত হয়ে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছেন সমস্ত পুরাতনকে তছনছ করতে। কি নাটক কি কাব্য-কবিতায় – সবেতেই তাঁর এই বিদ্রোহী সত্তার পরিচয় পাওয়া যায়। পাঁচালিকে পরিহার করে সৃষ্টি করলেন অমিত্রাক্ষর। প্রয়োগ করলেন সনেট। ক্লাসিক মহাকাব্যের নবায়ণ লক্ষ করা গেল তাঁর ‘মেঘনাদ বধ’ মহাকাব্যে। চিরাচরিত নায়কের অবস্থানে রামচন্দ্রকে নয়, বসালেন রাবনকে। নতুন দৃষ্টিকোণে পৌরাণিক নারীচরিত্রের নবমূল্যায়ণ করলেন ‘বীরাঙ্গনা’ কাব্যে। সমকালীন সমাজের বাবুসংস্কৃতি কিংবা গ্রাম্য জমিদার-তন্ত্রের অন্ধকার দিক তুলে ধরলেন তাঁর প্রহসনগুলির মধ্যে।
দ্বিশতবর্ষে মাইকেল মধুসূদন দত্ত-এর প্রাসঙ্গিকতা
মধুসূদন বহুচর্চিত ও বহুল আলোচিত-সমালোচিত একজন কবিপ্রতিভা। অথব কবিপ্রতিভার যথার্থ স্বীকৃতি তিনি তাঁর জীবিতকালে পাননি। এমনকি তাঁর সাহিত্যকীর্তি অনেকসময়ই সমালোচিত হয়েছে প্রকৃত মূল্যায়নের অভাবে। হয়তো তাঁর সাহিত্যের চরিত্রেরা আধুনিক নয়, সকলেই পৌরাণিক। তবুও সেইসব চরিত্রের মধ্যে দিয়েই তিনি আধুনিকতার বাণী শুনিয়েছিলেন। আজ দুশো বছরে পদার্পণ করা কবিকে আমরা ভুলিনি তাঁর নির্ভীক আধুনিক মননকে স্মরণ করে। তিনি যেভাবে কাব্যসাহিত্যের মাধ্যমে তথাকথিত প্রতিষ্ঠানকে আঘাত করে গিয়েছেন, যেভাবে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে আদর্শ স্বরূপ হয়েছেন; তাতে তাঁর অবদানকে অস্বীকার করা যায় না কোনোভাবেই। চলমান স্রোতের বিপরীতের সৈনিক যাঁরা, অবশ্যই তাঁরা মধুসূদনকে ভুলবেন। আমরাও ভুলব না আধুনিক বাংলা সাহিত্যের একজন বিদ্রোহী কবিসত্তাকে।
উপসংহার
দীর্ঘ রোগভোগ ও দারিদ্যের মধ্যে এই প্রতিভাবান কবির দেহাবসান হয় ১৮৭৩ সালের ২৯ জুন। মাইকেল তাঁর সমকালের দেশীয় সমাজে যাঁদের চারপাশে বসবাস করতেন, তাঁদের তুলনায় তিনি ছিলেন অনেক প্রতিভাবান। জনারণ্যে সবাইকে ছাড়িয়ে তাঁকে চোখে পড়ার মতো গুণাবলী তিনি প্রচুর পরিমাণে আয়ত্ত করেছিলেন কর্ম, কীর্তি ও জীবন-যাপনের মাধ্যমে। বাংলা সাহিত্যকে তিনি একা যতটা এগিয়ে দিয়েছিলেন, পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথ এবং নজরুল ছাড়া অন্য কেউ তা করতে পারেননি। মাইকেলের আমলের সমাজ চরিত্র এবং তাঁর মৃত্যুকালীন চিত্র শতবর্ষ পরেও আমাদের পীড়িত ও তাপিত করে মধুকবির জন্য পুঞ্জিভূত বেদনায়। কবির দ্বিশতজন্মবর্ষেও প্রতিধ্বনিত্ব করে বিষাদের ইতিবৃত্ত।
দ্বিশতবর্ষে মাইকেল মধুসূদন দত্ত, বাংলা প্রবন্ধ রচনা । দ্বিশতবর্ষে মাইকেল মধুসূদন দত্ত সম্পর্কে এই রচনাটি কেমন লাগল ? নিজেরা সংযোজ-বিয়োজনের মাধ্যমে রচনাটি নিজেদের মতো সাজিয়ে নিতে পারো।
জীবনী ও মনীষী সংক্রান্ত অন্য রচনা দেখতে ক্লিক কর