Last Update : July 28, 2023
বাঙালি বিজ্ঞান-সাধক জগদীশ্চন্দ্র বসু প্রবন্ধ রচনা PDF
ভারতের কোন বৃদ্ধ ঋষির তরুণ মূর্তি তুমি,
হে আর্য, আচার্য জগদীশ।’
—রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
সূচনা
ঊনবিংশ শতাব্দীতে ভারতের জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে এসেছিল যে নবজাগরণ, বিজ্ঞানাচার্য জগদীশচন্দ্র তার মূর্ত প্রতীক। উত্তরপুরুষদের অকর্মণ্যতায় প্রাচীন ভারতের দর্শন ও বিজ্ঞান-সাধনার সকল দুয়ার অবরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। ‘সেই সাধনার সে আরাধনার যজ্ঞশালার রুদ্ধদ্বার উন্মুক্ত করবার জন্যে আবির্ভূত হলেন প্রাচীন ভারতীয় ঋষির আধুনিক রূপমূর্তি আচার্য জগদীশচন্দ্র। তাঁর সাধনায় প্রাচ্যের দর্শন ও পাশ্চাত্যের বিজ্ঞানের মধ্যে রচিত হল নতুন সেতুবন্ধন।
জন্ম, বংশ-পরিচয় ও বাল্যজীবন
৩০শে নভেম্বর, ১৮৫৮ সাল। ঢাকার রাড়িখালে জগদীশচন্দ্রের জন্ম। পিতা ভগবানচন্দ্র বসু ছিলেন ফরিদপুরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। মাতা বামাসুন্দরী বসু। পিতার স্বদেশপ্রীতি, ও স্বদেশি শিল্প-প্রতিষ্ঠার উৎসাহ এবং মায়ের দেওয়া রামায়ণ- মহাভারতের জ্ঞান জগদীশচন্দ্রের জীবনে ব্যর্থ হয় নি।
শৈশবে গ্রামের পাঠশালায় অধ্যয়নকালে সাধারণ মানুষের সন্তানদের অভিজ্ঞতা এবং শিল্পী-কারিগরদের কর্ম-কুশলতা তিনি সঞ্চয় করে রেখেছিলেন তাঁর জীবন-পাত্রে।
উচ্চ-শিক্ষলাভ
ফরিদপুরের বাংলা স্কুলে শিক্ষালাভের পর জগদীশচন্দ্র ভর্তি হলেন কলকাতার হেয়ার স্কুলে এবং তারপর সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুলে। এখানে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে বি. এ. পাশ করে জগদীশচন্দ্র বিলাত যাত্ৰা করেন। লন্ডনে প্রাণীবিদ্যা এবং উদ্ভিদ-বিদ্যার পাঠ গ্রহণ করেও অসুস্থতার জন্যে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে বি. এ. এবং লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে বি.এস.সি. উপাধি গ্রহণ করে স্বদেশে ফিরে আসেন।
অধ্যাপনা জীবন
জগদীশচন্দ্র প্রেসিডেন্সি কলেজে গ্রহণ করলেন অধ্যাপকের পদ। শ্বেতাঙ্গ ও ভারতীয় অধ্যাপকদের বেতন-বৈষম্যের প্রতিবাদে তিনি তিন বছর কাল কোন বেতন গ্রহণ করলেন না। অবশেষে কর্তৃপক্ষ শ্বেতাঙ্গ ও ভারতীয় অধ্যাপকদের সমহারে বেতন দেবার যৌক্তিকতা স্বীকার করে তাঁকে তাঁর বকেয়া বেতন মিটিয়ে দেন। সেই অর্থে জগদীশচন্দ্র ঋণগ্রস্ত পিতাকে করলেন ঋণ-মুক্ত।
পদার্থবিদ্যার আবিষ্কার
বিজ্ঞান-বিষয়ে অনুসন্ধান-ব্যাকুলতা তাঁকে কোথাও থামতে দিল না। পরাধীন দেশের বৈজ্ঞানিক হওয়ার অভিশাপে বহু দুঃখ-আঘাত সত্ত্বেও অবশেষে বিদ্যুৎ-তরঙ্গ বিষয়ে তাঁর আবিষ্কার বিস্মিত করল তৎকালীন বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানীদের। লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ভূষিত করল ডি.এস-সি. উপাধিতে। পাশ্চাত্য জগৎ সেদিন সসম্ভ্রমে স্বীকার করে নিল এই ভারতীয় বিজ্ঞানীর মৌলিক আবিষ্কারের কথা। রবীন্দ্রনাথ পাঠালেন পরাধীন ভারত-জননীর ‘অশ্রুসিক্ত আশীর্বাদ’। বেতারযন্ত্র আবিষ্কারকের সম্মান, প্রকৃতপক্ষে, জগদীশচন্দ্রেরই প্রাপ্য।
কিন্তু মার্কনি জগদীশচন্দ্রকে অস্বীকার করে স্বয়ং লাভ করলেন ঐ দুর্লভ মর্যাদা। জগদীশ অত্যন্ত বেদনার সঙ্গে লিপিবদ্ধ করলেন— ‘যাঁহারা আমার বিরুদ্ধ পক্ষ ছিলেন, তাঁহাদের একজন আমার আবিষ্কার পরে নিজের বলিয়া প্রকাশ করেন।’
উদ্ভিদ বিদ্যায় আবিষ্কার
জগদীশচন্দ্র মানুষের বিশ্বাসঘাতকতায় বিরক্ত হয়ে পদার্থবিদ্যা ত্যাগ করে ফিরে এলেন উদ্ভিদ-বিদ্যায় আবিষ্কার উদ্ভিদ-বিদ্যার শ্যামল প্রশান্তির মধ্যে। বিশ্ব-জগতের সর্বত্রই জড় চেতনের প্রাণের নির্বাধ প্রকাশ– এই দার্শনিক উপলব্ধি প্রতিষ্ঠিত হল জগদীশচন্দ্রের বিজ্ঞান-সাধনায়।
নিজের তৈরি পেজোন্যান্ট যন্ত্রের সাহায্যে প্রাণী ও উদ্ভিদের দেহে বৈদ্যুতিক উত্তেজনায় সাড়া দেওয়ার বিষয়টা পরীক্ষা করে দেখান। ফটোসিনথেটিক বাবলার ও রেকর্ডার যন্ত্রের সাহায্যে ব্যাখ্যা করলেন উদ্ভিদজগতের চিরকালীন সালোকসংশ্লেষ পদ্ধতি। আবিষ্কার করলেন ক্রেস্কোগ্রাফ যন্ত্র। এই যন্ত্রে উদ্ভিদ দেহের সূক্ষ্মতম সঞ্চালনকে অনেক গুণ বড় দেখায়। গাছের বৃদ্ধির হারকে ১০ হাজার গুণ বাড়িয়ে পর্যবেক্ষণ করা যায়। যুগান্তকারী এই আবিষ্কার তৎকালীন বিশ্বের প্রথম সারির বিজ্ঞানীদের স্বীকৃতি লাভ করে। পোটোমিটার ও স্ফিগমোগ্রাফ যন্ত্র দিয়ে তিনি উদ্ভিদের মধ্যে প্রাণের অস্তিত্ব প্রমাণ করেন।
বসু-বিজ্ঞান মন্দির প্রতিষ্ঠা
অধ্যাপনা-বৃত্তি থেকে অবসর গ্রহণের পর জীবনের সমস্ত সঞ্চয় দিয়ে পরাধীন ভারতের বিজ্ঞানের গবেষণা-দৈন্য দূর করবার উদ্দেশ্যে তিনি ১৯১৭ সালের ৩০শে নভেম্বর স্থাপন করলেন ‘বসু-বিজ্ঞান মন্দির‘। বিজ্ঞানের রহস্য-পুরীর দ্বার, একে একে উন্মুক্ত করে, বিজ্ঞান-লক্ষ্মীর সেবায় বহু তরুণ প্রতিভাকে অনুপ্রাণিত করে এবং ভারতের বিপুল সম্ভাবনাময় বিজ্ঞান-সাধনার দ্বারোদ্ঘাটন করে ১৯৩৭ সালের ২৩ নভেম্বর এই বিজ্ঞান-বীর পরলোক গমন করেন। এই মহান বিজ্ঞান-সাধক তাঁর উত্তর-সাধকদের জন্যে যে বিজ্ঞান-মন্দির নির্মাণ করে গিয়েছেন, তা ব্যর্থ হবার নয়।
সাহিত্য চর্চা
জগদীশচন্দ্র একাধারে বৈজ্ঞানিক, দার্শনিক ও সাহিত্যিক। হতমান ভারত-সন্তান হিসাবে তিনি পরাধীনতার যে বেদনা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছেন, তা অশ্রুসিক্ত ভাষায় লিপিবদ্ধ আছে তাঁর ‘অব্যক্ত’ গ্রন্থে। ‘অব্যক্ত’ গ্রন্থ তাঁর বিজ্ঞান-মনীষা, দার্শনিক চেতনা ও সাহিত্য-প্রতিভার উজ্জ্বল সমাহার।
উপসংহার
জগদীশচন্দ্রের বিজ্ঞান-সাধনা দুঃখের সাধনা। বিশ্ব-বিজ্ঞানের এই মহান সাধক দীন-হীন ভারত-জননীর লাজনম্র শিরে পরিয়েছেন মহিমার যে গৌরব-মুকুট, তা ম্লান হবার নয়। তাঁর বিজ্ঞান-তপস্যা ভারতের সফল স্বপ্নের মধ্যে লাভ করুক চরম সার্থকতা।
'বাঙালি বিজ্ঞান-সাধক জগদীশ্চন্দ্র বসু প্রবন্ধ রচনা' এই শিরোনামে ৯টি পয়েন্টে একটি লেখা প্রকাশিত হল। তোমরা চাইলে আরও সুন্দরভাবে লেখাটি পরিবেশন করতে পারো।
মনীষী বিষয়ক অন্যান্য রচনা দেখতে এখানে ক্লিক কর
Table of Contents
পিডিএফ ডাউনলোড করতে নিচের লিংকে ক্লিক করুন