বিতর্ক্মুলক রচনায় নির্বাচিত বিষয়ের উপর পক্ষে বা বিপক্ষে একটি মত পরীক্ষায় দেওয়া হয়। ছাত্রছাত্রীদের দেয় বিষয়ের উপর পক্ষে/বিপক্ষে লিখতে হয় সংহতভাবে। বিষয়টি বুঝে নিয়ে, নানা যুক্তিক্রম সাজিয়ে প্রতিপক্ষের যুক্তি খণ্ডন করে নিজের মত প্রতিষ্ঠা করাই এই ধরণের রচনার মূল বৈশিষ্ট্য।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রাজনীতি বর্জন করা উচিৎ
পক্ষে মত
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নানা বিশৃঙ্খলার জন্য দায়ী রাজনীতি। এছাড়াও রাজনীতির কুপ্রভাব ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের অবনতির জন্য দায়ী। ইত্যাদি।
বিপক্ষে মত
দেশব্যাপী শিক্ষার অভাব এবং সচেতনতার অভাবেই মানুষ তার গণতান্ত্রিক অধিকার এবং সামাজিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। গণতান্ত্রিক অধিকার সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করার জন্য রাজনৈতিক শিক্ষা অত্যন্ত জরুরি। ছাত্র রাজনীতির ফলে সেই গঠনমূলক রাজনৈতিক শিক্ষার হাতেখড়ি সম্ভব। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রাজনীতির বর্জন বিষয়ক যে যে যুক্তি উপস্থাপিত হয়েছে, তা অসম্পূর্ণ ও অযৌক্তিক। আমরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রাজনীতির প্রাসঙ্গিকতা বিষয়ে কয়েকতি যুক্তি উপস্থাপিত করবো, যা প্রতিপক্ষের যুক্তিকে সহজেই ধরাশায়ী করতে পারে।
প্রথমত, ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে নিষ্ঠা, মেধা ও অধ্যয়নের কোনো বিরোধ নেই। নিষ্ঠাবান মেধাসম্পন্ন ছাত্র তার প্রতিভার যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে রাজনীতি এবং কর্মজীবন উভয় ক্ষেত্রেই চূড়ান্ত সাফল্যলাভ করতে পারে এবং রাজনৈতিক সচেতনতা তাকে ব্যক্তিজীবন থেকে সমাজজীবনে উন্নীত করে।
দ্বিতীয়ত, ছাত্রজীবনে রাজনীতি করার অর্থ বিশেষ রাজনৈতিক নেতা বা রাজনৈতিক দলের কুক্ষিগত হওয়া নয়। ভারতের মতো গণতান্ত্রিক দেশে বহুদলীয় রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিদ্যমান। তাই ছাত্রেরা নিজের ইচ্ছামতো রাজনৈতিক পথ গ্রহণ করতেই পারে। ভালো রাজনৈতিক নেতা এবং মহৎ মানুষের মধ্যে আপাত বিরোধিতার কোনো স্থান নেই বরং দুটি অস্তিত্বই ‘মহত্ব’ নামক অভিন্ন গুণের অধীন। তাই মহান নেতার মহান মানুষ হতে কোনো বাধা নেই। বিনয়, সহনশীলতা এবং শ্রদ্ধাভাব যে-কোনো মানুষের চারিত্রিক সম্পদ। ছাত্রজীবনে রাজনীতি করলে এই সম্পদগুলির বিলোপ ঘটে বলে মনে করার কোনো কারণ নেই। পক্ষান্তরে সহজাতভাবে এই সম্পদগুলি চরিত্রে থাকলে রাজনৈতিক জ্ঞানের সমন্বয়ে সেগুলি বিকশিত হয় এবং তারফলে সে বহু মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে।
তৃতীয়ত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ গভীরতর সমস্যাগুলি সর্বাধিক বোঝে শিক্ষার্থীরা, কারণ শিক্ষাব্যবস্থা অথবা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দুর্নীতি এদেরই সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত করে। ছাত্র রাজনীতির ফলে গড়ে ওঠে ছাত্র আন্দোলন, ফলে দূর হয় ছাত্রদের উপর নানা বঞ্চনা। তাই ছাত্রসমাজে বিশৃঙ্খলার ক্ষতিকর সম্ভাবনার প্রসঙ্গটি নিতান্তই গুরুত্বহীন হয়ে যায়। উপরন্তু ছাত্ররা নিজেদের সমস্যা ছাড়াও সমাজের যে-কোনো অন্যায়ের প্রতিবাদ করে বলে সমাজ উপকৃত হয়। ছাত্র রাজনীতির সপক্ষে সমর্থনের বিরুদ্ধে অনেকসময় স্কুল, কলেজ অথবা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ, ঘেরাও, অযৌক্তিক দাবি অথবা পারস্পরিক সংঘর্ষের অভিযোগ শোনা যায়। এ প্রসঙ্গে যুক্তিসংগত সমাধান হল–ছাত্র রাজনীতিতে যুক্ত ছাত্রদের যথাযথ প্রশিক্ষণ এবং পাঠদানের ব্যবস্থা করা। গঠনমূলক শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ কখনোই অশান্তি অথবা ক্ষতিকে ডেকে আনতে পারে না। কিন্তু সরকারেরও সচেতন থাকা উচিত যে দমন, বলপ্রয়োগ, গ্রেফতার যেন ছাত্র আন্দোলনকে হিংসার পথে প্ররোচিত না করে।
চতুর্থত, ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার অন্যতম উপাদান হল জনমত গঠনের অধিকার। ছাত্র রাজনীতি হল সেই অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক সোপান। অবাধ শান্তিপূর্ণ নির্বাচন তারই একটি অপরিহার্য অঙ্গ সুতরাং ছাত্র নির্বাচনকে নেতিবাচক দৃষ্টিতে বিশ্লেষণ না করে প্রশাসনিক নিরাপত্তার মাধ্যমে তার যথার্থ রূপায়ণ সরকারের কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। তাই ছাত্র-নির্বাচন বলতেই ছাত্রহিংসা নয়, বরং নির্বাচন করতে না দিয়ে ছাত্রদের কণ্ঠরোধ করলে সেটাই পরবর্তীকালে হিংসার কারণ হয়ে উঠতে পারে।
পঞ্চমত, আঞ্চলিক, প্রাদেশিক অথবা জাতীয় স্তরের রাজনৈতিক নেতারাই ছাত্র রাজনীতির পথপ্রদর্শক এ কথা ধ্রুব সত্য। কিন্তু এক্ষেত্রে তাদের আগমন অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক, কারণ প্রত্যেক রাজনৈতিক দলেরই একটি নির্দিষ্ট নীতি ও লক্ষ্য থাকে এবং তাকে অনুসরণ করাই হল নিষ্ঠাবান অনুগামীর কাজ। কান্ডারি ছাড়া যেমন জাহাজ অচল, তেমনই নেতাবিহীন আন্দোলন চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ হয়। কিন্তু নেতা অর্থে জনকল্যাণে নিবেদিত প্রাণ, জ্ঞানী এবং মহান হওয়াটাই সবচেয়ে জরুরি হলে ছাত্রসমাজের মঙ্গল ছাড়া অমঙ্গলের সম্ভাবনা একেবারেই থাকে না।