Last Update : December 1, 2023

স্বামী বিবেকানন্দ বাংলা প্রবন্ধ রচনা, Best unique 11 points, PDF
সূচনা
‘Get up O lions and shake off the delusion that you are sheep. ‘ -স্বামী বিবেকানন্দ
পরাধীনতার অন্ধকারে নিমগ্ন জাতির হৃদয়কে কে অগ্নিমন্ত্রে উজ্জীবিত করে তুলেছিলেন? কে এই জড়তাগ্রস্ত জাতিকে আত্মানুসন্ধানে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন?… কে এই সুপ্ত, নিশ্চেতন মহাদেশকে মৃত্যুঞ্জয়ী বাণী শুনিয়ে তাকে যৌবধর্মে দীক্ষিত করেছিলেন? – তিনি মহাসন্ন্যাসী বীরেশ্বর বিবেকানন্দ। ত্যাগ ও সাধনার মূর্ত প্রতীক তিনি, মুক্তি-সাধনার অগ্রদূত, আমাদের আদর্শ মানুষ স্বামী বিবেকানন্দ। জীবসেবায় শিবসেবা অবলোকন করে এবং কর্মকে ধর্মের রাজবেশ পরিয়ে তিনি সমগ্র পৃথিবীর গৌরবের ধন।
জীবনকথা
স্বামীজীর পূর্বাশ্রমের নাম নরেন্দ্রনাথ দত্ত। কলকাতার সিমুলিয়ায় ১৮৬৩ সালের ১২ জানুয়ারি জন্ম। পিতা বিশ্বনাথ দত্ত, মাতা ভুবনেশ্বরী দেবী। শৈশবেই তিনি পিতা-মাতার কাছে ভারতীয় সংস্কৃতির মূলভাবের পাঠ নেন। যৌবনে তিনি ব্রাহ্মসমাজ ও পাশ্চাত্য দর্শনের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। পরে শ্রীরামকৃষ্ণের সান্নিধ্যে এসে আমূল বদলে যান এবং তাঁর পরম ভক্ত হন। ১৮৯৩ খ্রি. শিকাগোতে অনুষ্ঠিত মহাধর্মসম্মেলনে হিন্দুধর্মের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন। ১৮৯৭ সালে শিবজ্ঞানে জীবসেবার উদ্দেশ্যে স্থাপন করেন ‘শ্রীরামকৃষ্ণ মিশন’। ১৯০২ খ্রি. বেলুড় মঠে মাত্র ৩৯ বছর বয়সে স্বামীজীর মানবলীলায় ছেদ পড়ে।
১৮৭১ খ্রি. নরেন্দ্রনাথ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশনে ভর্তি হন। নরেন্দ্রনাথ প্রেসিডেন্সি কলেজের (অধুনা প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা) প্রবেশিকা পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। তিনিই ছিলেন সেই বছর উক্ত পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ একমাত্র ছাত্র। তিনি প্রচুর বই পড়তেন। দর্শন, ধর্ম, ইতিহাস, সমাজবিজ্ঞান, শিল্পকলা ও সাহিত্য বিষয়ে বই পড়ায় তার বিশেষ আগ্রহ ছিল। বেদ, উপনিষদ্, ভাগবদগীতা, রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ প্রভৃতি গ্রন্থ পাঠেও তাঁর আগ্রহ ছিল। নিয়মিত অনুশীলন, খেলাধুলো ও সমাজসেবামূলক কাজকর্মে অংশ নিতেন।
জেনেরাল অ্যাসেম্বলি’জ ইনস্টিটিউশনে (অধুনা স্কটিশ চার্চ কলেজ, কলকাতা) পড়ার সময় নরেন্দ্রনাথ পাশ্চাত্য যুক্তিবিদ্যা, পাশ্চাত্য দর্শন ও ইউরোপীয় ইতিহাস অধ্যয়ন করেছিলেন।
সন্ন্যাস-গ্রহণ ও স্বামী বিবেকানন্দের ভারত-সাধনা
উত্তর কলকাতার বিখ্যাত দত্ত-পরিবারের দুরন্ত সন্তান এবং মেট্রোপলিটন, স্কুল ও জেনারেল এসেমব্লিজ কলেজের মেধাবী ছাত্র নরেন্দ্রনাথ শ্রীরামকৃষ্ণের স্পর্শে বীরসন্ন্যাসী বিবেকানন্দে পরিণত হলেন। সন্ন্যাস-ধর্মে দীক্ষা-গ্রহণ, হিমালয়ে সাধনা, পরিব্রাজকরূপে সমগ্র ভারত-ভ্রমণ, অজ্ঞ-দরিদ্র ও জাতপাতের সংকীর্ণতায় বিচ্ছিন্ন ভারতবাসীকে ‘অভীঃ’ মন্ত্রে দীক্ষা-দান তাঁর ভারত-সাধনার উজ্জ্বল দিক। বিশ্ব-হৃদয়-বিজয় তাঁর ভারত-সাধনারই আর-এক উজ্জ্বলতর দিগন্ত।
মত ও পথ
তিনি বহু শতাব্দীর ওপার থেকে নিয়ে এলেন বেদান্তের সাম্যবাণী : ‘ব্রহ্মময় জগৎ।’ ব্রহ্মময় সকল মানুষ। মানুষের সৃষ্ট বৈষম্য, শ্রেণিভেদ মিথ্যা; মানুষে- মানুষে সাম্যই বৈদান্তিক সাম্যবাদ। জাতিভেদে দীর্ণ ভারতবর্ষকে তাই তিনি ধিক্কার জানিয়েছেন। বিবেকানন্দের মতে, ত্যাগ ও বৈরাগ্যই ভারতের সনাতন আদর্শ। সমাজ-সেবাই হল মুক্তির পথ। স্বামীজী বলেছেন, সেবাধর্মের ঠিক ঠিক অনুষ্ঠান করতে পারলে অতি সহজেই সংসার-বন্ধন কেটে যায়। স্পর্ধা, ঔদ্ধত্য, কাপুরুষতা – এই তিন প্রকৃত শিক্ষার অন্তরায়। জগতে একটা দাগ রেখে যাওয়াই আমাদের অন্বিষ্ট হওয়া উচিৎ।
চিন্তানায়ক বিবেকানন্দ
জাতপাত-বৈষম্যের পরিবর্তে স্বামী বিবেকানন্দ শ্রেণিহীন-বর্ণহীন সমাজ-প্রতিষ্ঠার বাণী নিয়ে এলেন। সেখানে থাকবে না অশিক্ষা, দারিদ্র্য, কুসংস্কার। দৃপ্ত কণ্ঠে তিনি বললেন: ‘ক্ষুধার্ত মানুষকে ধর্মের কথ শোনানো বা দর্শনশাস্ত্র শেখানো তাহাকে অপমান করা।’ শেষ পর্যন্ত তিনি বললেন, ‘খালি পেটে ধর্ম হয় না।’ তিনি দেখেছিলেন এমন সমাজের স্বপ্ন, যেখানে ক্ষুধার আর্তনাদ থাকবে না, থাকবে না শোষণ। তাঁর গেরুয়া বসনের আড়ালে ছিল একজন প্রকৃত মানবতাবাদীর সুমহান হৃদয়।
রামকৃষ্ণ মিশন প্রতিষ্ঠা
১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দে আমেরিকার শিকাগো বিশ্বধর্ম-মহাসম্মেলনে সমন্বয়বাদী ভারতবর্ষের বিজয়-পতাকা উড়িয়ে দিয়ে স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের পর বিবেকানন্দ এই বিপর্যস্ত জাতির সংগঠনের মহান ব্রত নিয়ে ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠা করলেন তাঁর স্বপ্নের এক আদর্শ সঙ্ঘ – ‘রামকৃষ্ণ মিশন‘। ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হল নবযুগের পুণ্যতীর্থ – বেলুড় মঠ। রামকৃষ্ণ মিশন আজও তাঁর আদর্শকে বহন করে নবযুগের সন্ধানে ব্যাপৃত।
তরুণ সমাজ ও স্বামীজী
স্বামীজী-চর্চার মধ্যে দিয়ে বর্তমানের যুবশক্তি নিশ্চিত সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ খুঁজে পাবে। বিবেকানন্দের আধুনিক ও প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে ছিল সুস্থ-সবল দেহগঠনের কথা। মনের সঙ্গে সঙ্গে দেহের সবলতাও কাম্য হওয়া উচিৎ। স্বামীজী তরুণদের উদ্দেশ্যে বলেছেন, স্নায়ু সতেজ করতে। লৌহের মতো পেশি ও ব্জ্রের মতো স্নায়ু দেশগঠনের জন্য জরুরি।
বিবেকানন্দের আদর্শের গুরুত্ব
জীবপ্রেমের অভাবই আজ সবচেয়ে প্রকট। আজ একের দুঃখে অপরে বিচলিত হয় না; সবলের পেষণে দুর্বলের হাহাকার দেশে দেশে; ধনীর শোষণে দরিদ্রের দীর্ঘশ্বাস। পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষ আজও বুভুক্ষু, নিরক্ষর। অস্পৃশ্যতা, বর্ণ-বৈষম্য, কুসংস্কার, গোঁড়ামিতে সমাজের বেশিরভাগ মানুষ আজ জর্জরিত। আজও নারীর অধিকার সম্বন্ধে আমরা পুরোপুরি সচেতন নই। অথচ বিবেকানন্দ স্ত্রী-জাতির অধিকারের প্রশ্নে যথেষ্ট সচেতন ছিলেন। বিশ্বশান্তি, দেশোন্নয়ন, সশিক্ষা, সু-চরিত্রগঠনে স্বামীজীর বাণীর স্মরণ-মনন-প্রয়োগ বিশেষ জরুরি।
বলিষ্ঠ ভারত-গঠন
স্বামী বিবেকানন্দের আবির্ভাবের ফলে জন্মলাভ করল এক বলিষ্ঠ ভারত। ঘৃণ্য জাতিভেদই ভারতের অধঃপতনের কারণ। তাই তাঁর উদাত্ত বাণী হল: ‘বল, মূর্খ ভারতবাসী, দরিদ্র ভারতবাসী, চণ্ডাল ভারতবাসী আমার রক্ত, আমার ভাই…।’ সেই সঙ্গে শিবজ্ঞানে মানবতার পূজা এবং কর্মের মাধ্যমে মুক্তির সাধনাই ছিল এই বীর-সন্ন্যাসীর বীরবাণী :
‘বহুরূপে সম্মুখে তোমার, ছাড়ি কোথা খুঁজিছ ঈশ্বর?
জীবে প্রেম করে যেইজন, সেইজন সেবিছে ঈশ্বর।’
সাহিত্যচর্চা
গায়ক, চিত্রশিল্পী, আশ্চর্য ভাষাবিশারদ ও কবি বিবেকানন্দ ছিলেন একজন সম্পূর্ণ শিল্পী। বিবেকানন্দের উপদেশের মধ্যে রসবোধের পরিচয় পাওয়া যায় এবং তাঁর ভাষা ছিল সহজ-সাবলীল। বাংলা রচনার ক্ষেত্রে তিনি মনে করতেন, ভাষা এমন হওয়া উচিত যা লেখকের পাণ্ডিত্য প্রদর্শনের বদলে, লেখকের বক্তব্যের মূল ভাবটিকে ফুটিয়ে তুলতে পারবে। ‘বর্তমান ভারত’ হল বিবেকানন্দের লেখা একটি বিখ্যাত গ্রন্থ। তাঁর ‘প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য’, ‘পরিব্রাজক’, ‘ভাববার কথা’ প্রভৃতি মৌলিক গ্রন্থগুলি পাঠ করলে সহজেই উপলব্ধি করা যায় যে, কত দুরূহ ভাবকে কত সহজে প্রকাশ করা যায়। তাঁর সমস্ত রচনা ‘উদ্বোধন’ কার্যালয় থেকে প্রকাশিত দশখণ্ডের “স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা”-তে সংকলিত হয়েছে।
উপসংহার
বিবেকানন্দ ভারত-আত্মার জ্যোতির্ময় প্রতীক। ভারতকে তিনি পরিণত করেছেন মহামানবতার পুণ্য পীঠস্থানে। এই মহাসন্ন্যাসী ভারতকে আত্মজ্ঞানের জাগরণের যে বাণী শুনিয়েছিলেন, দেশের এই ঘোর দুর্দিনে আমরা যেন শুনতে পাই তাঁর সেই অগ্নিগর্ভ বীরবাণী।
স্বামী বিবেকানন্দ বাংলা প্রবন্ধ রচনা — লেখাটি কেমন হল জানাতে ভুলো না। তোমরা নিজেরা তোমাদের মননবোধ ও শৈলীর সাহায্যের এই রচনার উন্নতিসাধন ঘটিয়ে তোমাদের কাজে লাগাতে পার।
জীবনীমূলক অন্যান্য রচনা দেখতে এখানে ক্লিক কর
Table of Contents
স্বামী বিবেকানন্দ বাংলা প্রবন্ধ রচনা অনুসরণে তোমরা এই ধরণের রচনা লিখতে পারো : বীরেশ্বর বিবেকানন্দ, তোমার জীবনের আদর্শ মহাপুরুষ প্রভৃতি।