Last Update : November 23, 2023
১২৫তম জন্মবর্ষে নেতাজী সুভাষচন্দ্র প্রবন্ধ রচনা, best 9 unique points, PDF
ভূমিকা
ভারতের মুক্তি সংগ্রামের অপরাজেয় ঋত্বিক ও বহু বিচিত্র কর্মোদ্যোগের মূর্ত প্রতীক দেশগৌরব নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে ২৩শে জানুয়ারি উড়িষ্যার কটক শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা জানকীনাথ বসু ছিলেন কটকের সরকারি উকিল। রত্নগর্ভা প্রভাবতী দেবী ছিলেন তাঁর মাতা। জানকীনাথের পৈত্রিক নিবাস ছিল চব্বিশ পরগণা জেলার কোদালিয়া গ্রামে। সুভাষচন্দ্র পরাধীন জাতির পুরাতন চিত্তে নতুন প্রাণসঞ্চারের পুণ্যব্রত গ্রহণ করেছিলেন।
জীবনী
ভারত জননীর বিদ্রোহের যে অগ্নিশিশু কটক শহরে ভূমিষ্ঠ হয়েছিলেন তাঁর জীবন ছিল অবিরাম সাধনার। কটক শহরেই নেতাজীর পাঠ্যজীবন শুরু হয়। কটকের র্যাভেনশ কলেজিয়েট স্কুলের ছাত্র সুভাষচন্দ্র প্রবেশিকা পরীক্ষায় দ্বিতীয় স্থান লাভ করে কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হন। তারপর ভর্তি হন কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে। এই কলেজে ভারতীয়দের প্রতি ইংরেজ অধ্যাপক ওটেন সাহেবের কটূক্তির প্রতিবাদে বিক্ষোভ দেখাবার অপরাধে তিনি কলেজ থেকে বহিষ্কৃত হন। এর পর তিনি স্যার আশুতোষের চেষ্টায় দর্শন শাস্ত্রে অনার্স নিয়ে স্কটিশ চার্চ কলেজে ভর্তি হন এবং প্রথম শ্রেণির অনার্স সহ বি. এ. পাশ করেন। তাঁর পিতার ইচ্ছানুযায়ী ইংল্যান্ড যান এবং ১৯২০ সালে আই. সি. এস. পরীক্ষায় চতুর্থ স্থান পেয়ে কৃতকার্য হন।
কর্মমুখর যৌবনকাল
দেশবন্ধুর শিষ্যত্ব গ্রহণ করার পর তাঁর কর্মজীবন হয়ে উঠল রোমাঞ্চকর ও ঘটনাবহুল। এ বিষয়ে তিনি তরুণ সমাজের বিপুল সমর্থন পেয়েছিলেন। দেশবন্ধুর নির্দেশে তিনি জাতীয় শিক্ষালয়ের অধ্যক্ষ পদ গ্রহণ করেন। এই সঙ্গে তিনি পেলেন কংগ্রেস কমিটির প্রচার সচিবের পদ। তারপর ইংল্যান্ডের যুবরাজের ভারত আগমন উপলক্ষে হরতালের আহ্বায়ক রূপে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। কারাবাসের পর বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটির সম্পাদক পদে তিনি যোগদান করেন। এরপর উত্তরবঙ্গের বন্যাত্রাণে তাঁর গৌরবময় ভূমিকার কথা ইতিহাসে চিরদিন স্মরণীয় হয়ে থাকবে। এরপর তিনি ‘ফরোয়ার্ড’ পত্রিকার সহকারী সম্পাদক ও পরে কলকাতা পৌর নিগমের প্রধান কর্মকর্তা নিযুক্ত হন। তাঁর জনপ্রিয়তা ও নেতৃত্বদানের বিস্ময়কর ক্ষমতা এবং সংগ্রামী দেশনায়কের অপ্রতিরোধ্য শক্তি দেখে ইংরেজ সরকার ভীত ও সন্ত্রস্ত হন। তাই ইংরেজরা তাঁকে কারাগারে পাঠিয়ে নিরাপদ হতে চাইলেন। এভাবে একবার, দুবার নয়, বহুবার তাঁকে কারাবরণ করতে হয়। স্বাধীনতার এই একনিষ্ঠ সৈনিককে তাই জীবনের বেশিরভাগ সময়ই কাটাতে হয় কারান্তরালে।
কংগ্রেসের সভাপতি পদ ও কংগ্রেস ত্যাগ
দেশবন্ধু ছিলেন স্বরাজ বা পূর্ণ স্বাধীনতার সমর্থক। নেতাজীর পথও ছিল তাই। ১৯৩৮ ও ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি হরিপুরা ও ত্রিপুরীতে নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির সভাপতির পদ অলঙ্কৃত করেন। ত্রিপুরী কংগ্রেসে মহাত্মা গান্ধীর বিরোধিতা সত্ত্বেও সুভাষের সভাপতি নির্বাচন তাঁর অসাধারণ জনপ্রিয়তারই প্রমাণ দেয়। এরপর নেতাজীর চরমপন্থী চিন্তাধারার সঙ্গে কংগ্রেসের আপোসপন্থী ও মধ্যপন্থী দলের মতবিরোধ হয়। তিনি ছিলেন চরমপন্থীদের অগ্রনায়ক। তাঁর সভাপতি নির্বাচনে নরমপন্থীরা বিক্ষুদ্ধ হলে তিনি অসন্তুষ্ট হয়ে কংগ্রেস ত্যাগ করে ‘ফরওয়ার্ড ব্লক’ গঠন করেন ও জাতিকে স্বাধীনতা অর্জনের পথে নতুন ভাবে দীক্ষিত করতে চাইলেন।
পথ পরিবর্তনের ভাবনা
ইতিমধ্যে শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। সুভাষচন্দ্র ভারতে স্বাধীনতা সংগ্রামের ব্যাপারে পূর্ণ সুযোগ গ্রহণ করতে চাইলেন এই বিশ্বযুদ্ধের সময়। বিশ্বব্যাপী ইংরেজের প্রতি বিরোধিতাকে পথ পরিবর্তনের ভাবনা ছড়িয়ে দিতে চাইলেন তিনি। কিন্তু তার জন্য যে শক্তি ও অস্ত্রবল দরকার তার অভাব উপলব্ধি করলেন। এজন্য তিনি বিদেশে পাড়ি দেবার কথা ভাবলেন। এসময়ে তাঁর সঙ্গে জওহরলাল ও গান্ধীজির আবার মতবিরোধ হয়। ইংরেজ সুভাষচন্দ্রকে তাদের সামনে মূর্তিমান বিপদ ভেবে তাকে নজরবন্দী করে রাখে। কিন্তু দেশপ্রেমের মূর্ত প্রতীক সুভাষচন্দ্র রক্ষীদের চোখে ধুলো দিয়ে বিদেশে পাড়ি দেন।
নেতাজির ডাক–ভারত আগমন ও পরাজয়
সেই সময় ইংরেজের শত্রু দেশ জাপানে পৌঁছে তিনি আজাদ হিন্দ বাহিনীর সর্বাধিনায়কের পদ গ্রহণ করে তাকে আরও শক্তিশালী করে গড়ে তোলেন। সবাই তাকে ‘নেতাজী’ রূপে বরণ করল। নেতাজীর চোখে তখন ভারতবর্ষের স্বাধীনতার স্বপ্ন, কণ্ঠে বজ্র গম্ভীর আহ্বান—’তোমরা আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব।’ সেই সঙ্গে তাঁর নির্দেশ—‘দিল্লি চলো।” আজাদ হিন্দ বাহিনী ‘জয় হিন্দ’ বলে এগিয়ে চলে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে, লক্ষ্য দিল্লির লালকেল্লা।
১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে আজাদ হিন্দ ফৌজ নেতাজীর নেতৃত্বে ইংরেজের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করল, যুদ্ধ চলতে থাকল। ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দে আজাদ হিন্দ ফৌজ ভারতের মাটি কোহিমায় স্বাধীন জাতীয় পতাকা উত্তোলন করলেন। কিন্তু জাপানের অসহযোগিতা এবং বিশ্বযুদ্ধে জাপানের পরাজয় আজাদ-হিন্দ বাহিনীকে দুর্বল করে। এই সময় সুভাষচন্দ্র জাপানের তাইহোকু বিমান বন্দর থেকে বিমানে যাত্রা করেন সাহায্যের আশায়। তারপর আর নেতাজীর কোন খবর পাওয়া যায় না।
মৃত্যু রহস্য
অনেক দেশবাসী তাঁর মৃত্যুসংবাদ বিশ্বাস করে না। কোন কোন গবেষক এও প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন যে, নেতাজী জীবিত, তাঁকে সাইবেরিয়ার জেলে বন্দী রাখা হয়েছিল। আবার কেউ কেউ বলেন, তাঁকে মেরে ফেলা হয়েছিল। এ নিয়ে কমিশনও বসেছে কিন্তু রহস্য যেই তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই থেকে গেছে। চিরপথিক সুভাষ আমাদের কাছে থেকে গেলেন নিরুদ্দেশের পথিক।
তাঁর আদর্শ
দেশমাতৃকার চরণে উৎসর্গীকৃত প্রাণ নেতাজী আমাদের কাছে এক আদর্শ ব্যক্তিত্ব। ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে আপোসহীন সংগ্রাম, দেশবাসীর জন্য সমবেদনা, তাঁর মহান ত্যাগ আমাদের আদর্শ ও ধ্যানধারণা কাছে পাথেয় স্বরূপ। তারুণ্যের মূর্ত প্রতীক সুভাষচন্দ্র তরুণ সমাজের কাছে আদর্শস্থল।
উপসংহার
ভারতের স্বাধীনতা ছিল নেতাজীর ধ্যান, জ্ঞান। আজ ভারতবর্ষ স্বাধীন। কিন্তু বিভিন্ন সুবিধাবাদী শক্তি ভারতবর্ষের অখণ্ডতাকে নানাভাবে আঘাত করার চেষ্টা করছে। এই প্রেক্ষিতে এই মহান দেশপ্রেমিকের আদর্শ ও ধ্যানধারণাকে নতুন করে ছড়িয়ে দেবার সময় এসেছে। যিনি নিজের জীবনকে তুচ্ছ করে আপোসহীন সংগ্রাম করে গেছেন দেশমাতৃকার শৃঙ্খল মোচন করার জন্য, তাঁর প্রতিকৃতি সামনে রেখে সামরাই আবার দেশদ্রোহী ক্রিয়াকলাপে লিপ্ত হচ্ছি।