বিতর্কমূলক রচনায় নির্বাচিত বিষয়ের উপর পক্ষে বা বিপক্ষে একটি মত পরীক্ষায় দেওয়া হয়। ছাত্রছাত্রীদের দেয় বিষয়ের উপর পক্ষে/বিপক্ষে লিখতে হয় সংহতভাবে। বিষয়টি বুঝে নিয়ে, নানা যুক্তিক্রম সাজিয়ে প্রতিপক্ষের যুক্তি খণ্ডন করে নিজের মত প্রতিষ্ঠা করাই এই ধরণের রচনার মূল বৈশিষ্ট্য।
পরীক্ষায় প্রাপ্ত নম্বর সাফল্যের একমাত্র মাপকাঠি নয়
sahajbanglarachana.com
পক্ষে
পরীক্ষায় প্রাপ্ত নম্বর জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ক্ষেত্রে সর্বদা প্রাধান্য পায় না। পরীক্ষার প্রাপ্ত নম্বর জীবনের শেষ কথা বলে না। শিক্ষা বোঝা নয়, শিক্ষার আনন্দই হলো মুখ্য। ইত্যাদি।
বিপক্ষে
পরীক্ষায় প্রাপ্ত নম্বর প্রায়শ সাফল্যের মাপকাঠি হয়ে দাঁড়ায়। তাকে অস্বীকার করলে তা ভাবের ঘরে চুরি ছাড়া আর কিছু বলা যায় না। অনেকসময় শোনা যায় জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ক্ষেত্রে পরীক্ষার নম্বর সর্বদা প্রাধান্য পায় না। কথাটা আপাত শ্রুতিমধুর হলেও বাস্তবক্ষেত্রে তার বিপরীত দিক লক্ষ করা যায়। একটি ছাত্র যখন মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে উচ্চমাধ্যমিক স্তরে ভরতি হতে যায় তখন তার পরীক্ষায় প্রাপ্ত নম্বরকে গুরুত্ব দিয়ে মূল্যায়ন করা হয়। শিক্ষার্থীটির হয়তো বিজ্ঞান পড়ার বাসনা ছিল, কিন্তু প্রাপ্ত নম্বরের ভিত্তিতে সে সেই সুযোগ পেল না। তখন তাকে কলা বা বাণিজ্যশাখায় ভরতি হতে হয়। মনের থেকে সায় না থাকায় খুব একটা ভালো নম্বর পায় না। তাহলে সে কি মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে না, এমন কথা কেউ নিশ্চিন্ত হয়ে বলতে পারবে?
পরীক্ষায় প্রাপ্ত নম্বর সাফল্যের মাপকাঠি নয়— এই যুক্তির যারা প্রবক্তা তারা উদাহরণ হিসেবে রবীন্দ্রনাথের ‘তোতাকাহিনি’র প্রসঙ্গকে বার বার টেনে আনেন। ইংরেজ সরকার প্রবর্তিত শিক্ষানীতি, শিক্ষা ব্যবস্থা ও শিক্ষাদানের পদ্ধতিতে ত্রুটি ও অসংগতির অন্ত ছিল না। যাদের উপর শিক্ষার দায়িত্ব, তারা শিক্ষার্থীদের প্রতি মমত্বহীন ছিলেন। শিক্ষাদানের নামে আছে বিশাল অট্টালিকা, রাশি রাশি পুস্তক ও শিক্ষকবৃন্দের উপস্থিতি। ‘তোতাকাহিনি’ রূপক রচনায় অন্তঃসারশূন্য যান্ত্রিক সভ্যতার বাহক শিক্ষাব্যবস্থার ভয়াবহ রূপকে তীক্ষ্ণ ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে। শিক্ষাব্যবস্থায় ভণ্ডামি, আত্মপ্রতারণা ও ব্যয়বাহুল্যের বাস্তব বিবরণ ‘তোতাকাহিনি’।
এই প্রসঙ্গে মনে রাখতে হবে এরপর প্রায় শতবর্ষ অতিক্রান্ত হতে চলল। শিক্ষাব্যবস্থার পরিকাঠামোর ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে। রবীন্দ্রনাথের আক্রমণের মূল লক্ষ্য ছিল লর্ড মেকলে প্রবর্তিত শিক্ষাব্যবস্থা। সেই শিক্ষাব্যবস্থা মূলত ছিল করণিক উৎপাদনের কারখানা। সেখানে যে-কোনো প্রকারে ডিগ্রি অর্জন করে ব্রিটিশের সওদাগরি অফিসে নিজেকে সমর্পণ করাকে শিক্ষার্থীরা জীবনের মোক্ষ বলে মনে করত। কিন্তু যখন দেখা গেল চাকরির পদের অপেক্ষা প্রার্থীর সংখ্যা অধিক হয়ে গিয়েছে তখনই মনে অসন্তোষ জাগ্রত হল। তাহলে কেবল ডিগ্রি অর্জন করলে চলবে না। বর্তমান যুগে এইভাবে ডিগ্রি অর্জনে কানাকড়ি জুটবে না, পরীক্ষার্থীরা হতাশার অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে যেতে বাধ্য।
sahajbanglarachana.com
আমাদের সমাজে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সুপ্রতিষ্ঠিত এমন অনেক মানুষ আছেন যাঁরা পরীক্ষার সাফল্যকে শুধুমাত্র গুরুত্ব না দিয়ে নিজ নিজ দক্ষতায় স্ব স্ব ক্ষেত্রে সুনাম অর্জন করেছেন। মানতে হবে এঁরা সবাই ঈশ্বরপ্রদত্ত প্রকৃতিগত মেধার অধিকারী। কিন্তু এঁদের সংখ্যা কত?
পরীক্ষার সাফল্য বা ব্যর্থতা অভিভাবকদের কাছে গুরুত্ব পাওয়ার ফলে অনেকের মতে তা শিক্ষার্থীর জীবনে বাড়তি চাপ সৃষ্টি করে। সেক্ষেত্রে অভিভাবকদের এ সম্পর্কে সচেতন করে তুলতে হবে, তাঁরা যেন শিক্ষার্থীর উপর অযথা মানসিক চাপ সৃষ্টি না করেন। আর মানসিক অবসাদ বর্তমান জটিল সমাজব্যবস্থার গভীর অসুখ। মানুষ যে কখন আর কেন দুরারোগ্য মানসিক ব্যধিতে আক্রান্ত হয়ে পড়বে, তা কেউ বলতে পারবে না। সেজন্য জীবনের লক্ষ্য বা সাফল্যকে দায়ী করলে চলবে না। তা ছাড়া বর্তমান প্রজন্মের শিক্ষার্থীরা নিজেদের ‘কেরিয়ার’ সম্পর্কে অনেক বেশি সচেতন। আর তারা সর্বদা পাঠ্যপুস্তক বা পুথিগত শিক্ষার বাইরে নিজেদের মনের রসদ খুঁজে নেয়। বৈদ্যুতিক ব্যবস্থা শিক্ষার্জনের পথকে অনেক সুগম করে নিয়েছে। প্রথাগত শিক্ষার বাইরে গিয়ে তারা মনের অবকাশ খুঁজে নেয়।
জীবনে সাফল্যের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট একটি লক্ষ্য থাকা প্রয়োজন। ভবিষ্যৎ জীবনে নিজেকে কীভাবে প্রতিষ্ঠিত করবে সে সম্পর্কে সংকল্প থাকা উচিত। দিশাহীন পদক্ষেপ মানুষকে বিভ্রান্ত করে। পরিণামে জীবনে নেমে আসে ব্যর্থতা আর হতাশা, সেজন্য নম্বর প্রাপ্তিকে কোনোভাবে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো যায় না। প্রত্যেকের জীবনে নিজস্ব প্রবণতা থাকে। সেই প্রবণতা অনুসারে জীবিকা নির্বাচন না হলে ব্যর্থতা অবশ্যম্ভাবী, আর সেক্ষেত্রে সাফল্যের জন্য নম্বর প্রাপ্তিকে গুরুত্ব দিতে হবে। সুতরাং জীবনের লক্ষ্য স্থির করতে মানসিক প্রস্তুতি ও পরীক্ষার সাফল্য একান্ত অপরিহার্য।
sahajbanglarachana.com
মানুষের সমগ্র জীবনটাই উদ্দেশ্য ও উপায়ের সমন্বয়। অকূল সমুদ্রে ভাসমান জাহাজ যেমন কম্পাঙ্কের কাঁটাকে লক্ষ রেখে অভীষ্টের দিকে অগ্রসর হয়, মাবনজীবনও তার ব্যতিক্রম নয়। সম্ভাবনা ও সামর্থ্যের দিকে লক্ষ রেখে ভবিষ্যৎ জীবনের পরিকল্পনা করতে হবে। জীবনের লক্ষ্য নির্ণয়ে সর্বপ্রকার সতর্কতা ও সচেতন দৃষ্টিভঙ্গি একান্ত প্রয়োজন। আর সেক্ষেত্রে পরীক্ষার সাফল্য একমাত্র মাপকাঠি। বর্তমানে শিক্ষাঙ্গনে এবং পরবর্তী জীবনে প্রতিষ্ঠার জন্য মানুষকে প্রতি মুহূর্তে প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হতে হয়। সেক্ষেত্রে সাফল্যের মাপকাঠিরূপে নম্বরেরই প্রাধান্য। সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি ও শিক্ষাব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন না ঘটলে সাফল্যের হাতিয়াররূপে নম্বর প্রাপ্তিকে অস্বীকার করা যাবে না।
sahajbanglarachana.com