সূচনা
বিচিত্র অভিজ্ঞতার সঞ্চয়ে মানুষের মনের মণিকোঠা সমৃদ্ধ হয়, আর সেই সমৃদ্ধির কারণেই জীবনে আসে সাফল্য। কারণ অভিজ্ঞতা মানুষকে ইতিবাচক কর্তব্য নির্ধারণে সাহায্য করে, ভাল-মন্দ বিচারে সহায়তা করে। অভিজ্ঞতায় যে যত সমৃদ্ধ, বাস্তব জীবনের পথ পরিক্রমায় সে তত গতিময়। আমার বিদ্যালয় জীবনের নানান অভিজ্ঞতার মধ্যে প্রধান শিক্ষকের অবসর গ্রহণ উপলক্ষে বিদায় সম্বর্ধনার দৃশ্য দেখার অভিজ্ঞতা আমাকে বাস্তব জীবন সম্বন্ধে সবচেয়ে বেশি সমৃদ্ধ করেছে, পরবর্তী জীবনে সেই অভিজ্ঞতা আমাকে দিয়েছে রসদ।
প্রসঙ্গ
যতদুর মনে পড়ে, দিনটা ছিল শ্রাবণ মাসের এক বৃহস্পতিবার। আমি তখন পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র, সবেমাত্র স্কুলে ভর্তি হয়েছি। তখনো বিদ্যালয় জীবনের আদবকায়দা রপ্ত করতে পারিনি। আগের দিন, আমাদের শ্রেণি শিক্ষক এসে জানিয়ে গেলেন, আগামীকাল আমাদের বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক তাঁর চাকরি জীবন থেকে অবসর গ্রহণ করবেন, তাই সকলে যেন সেদিন উপস্থিত হয়। তখন তো অবসর গ্রহণ ব্যাপারটি কি, তা উপলব্ধি করতে পারিনি। বাড়িতে গিয়ে বাবাকে জিজ্ঞাসা করেছি, বাবা বুঝিয়ে দিয়েছেন—চাকরি জীবনের মেয়াদ ফুরিয়ে গেলে চাকরি থেকে অবসর নিতে হয়। মানুষ যেমন সারাদিন কাজ করার পর রাত্রে বিশ্রাম নেয়, চাকরি জীবনের অবসরও সেরকম ব্যাপার।
sahajbanglarachana.com
অনুষ্ঠানের বিবরণ
গত রাতে অবসর সম্পর্কে বাবার দেওয়া ব্যাখ্যা কিছুটা বুঝেছিলাম ঠিকই, কিন্তু সমস্তটা অনুধাবন করতে পারিনি। অনুধাবন করলাম স্কুলে এসে বিদায় সম্বর্ধনার অনুষ্ঠান দেখে। অনুষ্ঠান মঞ্চে পৌঁছে দেখলাম এক থমথমে ভাব। সকলের মধ্যে বিরাজ করছে বিষাদের সুর। আর বাইরে প্রকৃতির অবিরাম ধারা বর্ষণ। মঞ্চে উপস্থিত অতিথিদের মধ্যে বিদায়ী প্রধান শিক্ষক মহাশয় বসে রয়েছেন। তিনিও বিষাদগ্রস্ত। উপস্থিত অতিথি ও অন্যান্য শিক্ষক মহাশয়গণ প্রধান শিক্ষকের নানান কাজ ও সেইসব কাজের স্মৃতিচারণা করছিলেন, আর তার থেকে উঠে আসছিল এক মহান মানুষের কীর্তিগাথা। তাঁর ত্যাগ, নিষ্ঠা, ধৈর্য, মহানুভবতা, ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে সম্পর্কের বন্ধন প্রভৃতি গুণাবলীর সঙ্গে যুক্ত তাঁর জীবনের নানান ঘটনা। বেশ মনে পড়ে, বয়সটা কম হলেও বক্তব্য পরিবেশনের গুণে ও পরিবেশের সামঞ্জস্যে সেই সময়টা আমার মনের মণিকোঠায় সজ্জিত হয়ে রয়েছে। শুধু বক্তৃতা নয়, ঐ অনুষ্ঠানে পরিবেশিত একটি গান এখনো স্মরণ করলে আমার মনকে ভরিয়ে দেয়—
যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে
তখন নাই বা মনে রাখলে
sahajbanglarachana.com
স্মরণীয় কেন
সব অভিজ্ঞতা স্মৃতিতে দাগ কাটে না। কিন্তু কিছু কিছু অভিজ্ঞতা আছে যা কোনদিনই ভোলা যায় না। কেননা সেই অভিজ্ঞতা আমাদের হৃদয়কে নাড়িয়ে দেয়। তখন সেই সুরের দোলায় জেগে ওঠে প্রাণ। প্রধান শিক্ষক মহাশয়ের বিদায় সম্বর্ধনার অভিজ্ঞতা স্মরণীয় হয়ে ওঠার কয়েকটি কারণ হল: (এক) সেই বিদায় দৃশ্য আমাকে জীবনের মূল কথাটি উপলব্ধি করতে শিখিয়েছে। তা হল জন্ম মৃত্যু, জোয়ার-ভাটা, সুর্যোদয়-সূর্যাস্ত, সৃষ্টি-ধ্বংস-এর মতো জাগতিক সত্যকে। (দুই) কীর্তির মধ্যেই মানুষ বেঁচে থাকে, বিদ্যা অর্থ-বৈভবের মধ্যে নয়। (তিন) আমরা আয়নায় আমাদের মুখ দেখি, কিন্তু মানুষের ব্যবহার ও আচার-আচরণ হল তাঁর চরিত্রের আয়না। (চার) বিদায় সুখের হয় তখনই যখন তার মধ্যে প্রাণের স্পন্দন, সুরের ছোঁয়া লাগে। সমবেত সকলের উপস্থিতিতে, তাঁদের স্বীকৃতিতে, তাঁদের চোখের জলে বিদায়ের দৃশ্যও সুখের হয়ে উঠতে পারে। (পাঁচ) বিস্মৃতি ও দুঃখ-এর মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী হল দুঃখ।
শেষকথা
আমার বিদ্যালয় জীবনের প্রথম পর্বে প্রধান শিক্ষকের বিদায় সম্বর্ধনার অনুষ্ঠান-এর অভিজ্ঞতা আমাকে জগৎ ও জীবনের মুখোমুখি করিয়ে দিয়েছিল। কোন একটি ঘটনা যে জীবনকে এত ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করতে পারে, তা ভাবলে বিস্মিত হতে হয়। প্রধান শিক্ষক মহাশয়ের বিদায় দৃশ্যের পর আমার জীবনের ব্রত হল—এই নশ্বর জীবনে ভাল কাজের দ্বারা ত্যাগ ও সেবার মাধ্যমে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা, কীর্তির মধ্যে বেঁচে থাকা–মৃত্যুর পরও অমর হয়ে থাকা।
sahajbanglarachana.com